লাবণ্য আর এক অচেনা আইনস্টাইন –আসিফ শুভ্র

0

‘ ঐ মিয়া ! ঐ ……..
নবাবের মত রাস্তা পার হন কেন ? আরেকটু হইলেই তো গেছিলেন চাক্কার তলে ! ‘
ড্রাইভার রশীদ হার্ডব্রেক করলো টয়োটা এলিয়ন গাড়িটা । রশীদ ড্রাইভিং সিটের পাশের গ্লাসটা নামিয়ে চিল্লাচ্ছে পাগলের মত। একটা ছেলে রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে । বয়স আনুমানিক পঁচিশ। ফর্সা , সুন্দর এক তরুণ। গাড়ির ধাক্কায় বেশ আঘাত পেয়েছে । ছেলেটার মোটা ফ্রেমের চশমাটা রাস্তার একপাশে পড়ে আছে । মুখ হাত পা ছিলে গেছে , হাতের ফাইলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাস্তায় ।
লোকজন জড়ো হবার আগেই একটানে কেটে পড়া উচিত । আজ কালকার পোলাপাইন। গাড়ীর বারোটা বাজিয়ে দেবে । রশীদ গাড়িটা ব্যাকে এনে চম্পট মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
—‘ এ্যাই রশীদ ! এ্যাই ! গাড়ি থামাও !
স্টুপিড নাকি তুমি ! এভাবে একটা মানুষকে রাস্তায় আহত করে পালিয়ে যাবে ? ‘
গাড়ির মধ্যে বসে যিনি রশীদ কে ঝাড়ি মারলেন – তার নাম লাবণ্য । সদ্য বিবিএ পাশ করে একটা প্রাইভেট কম্পানীতে জয়েন করেছেন । আনিন্দ্য সুন্দর মেয়ে লাবণ্য । গাড়ির মালিক লাবণ্যের মামা । মামার বাড়িতে থেকেই বিবিএ পাশ করেছে লাবণ্য ।
—‘আফা ! লোকজন জড়ো হইতাছে । ঝামেলা করবো। ঢাকার পাবলিকে বহুত বদ । গাড়ি ভাঙ্গার ওস্তাদ । গাড়ির কিছু হইলে – আপনের মামায় আমারে…………’
— ‘ চুপ করো ! স্টুপিড একটা । ‘
লাবণ্য গাড়ির দরজা খুলে নামলো । ‘
ছেলেটা ভালোই অাঘাত পেয়েছে । নাকে মুখে ধুলোবালি লেগে আছে। কপালের বাঁ দিকে বেশ খানিকটা কেটে গেছে । লাবণ্য ছেলেটার চশমা তুলে দিলো। পাবলিক জড়ো হচ্ছে । ট্রাফিক পুলিশ এসেছে । সাথে সার্জেন্ট ও আছে। পাবলিক সব চিল্লাছে ।
চার পাঁচটা চ্যাঙরা পোলাপাইন হাতে ইট নিয়েছে । গাড়ির গ্লাসে মারবে মনে হয় । রশীদ এক দৌড়ে ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে গিয়ে চিল্লাতে চিল্লাতে বললো –
‘ ওস্তাদ ! আপনেই বিচার করেন । সিগনাল পড়ে নাই । পড়ছে !!! এই মিয়া সিগনাল ছাড়া রাস্তা পার হইতেছিলো ক্যান ! আমি হার্ড ব্রেক না করলে তো এতক্ষণে……..’
ছেলেটা হা করে তাকিয়ে আছে । বোকা বোকা চেহারা । পাবলিক অতি উৎসাহী হয়ে জট পাকাচ্ছে। মনে হয় বাংলা সিনামার শুটিং দেখছে !
—‘ আপনার নাম কি ? এভাবে রাস্তা পার হচ্ছিলেন কেন ? আরেকটু হলে তো মারা পড়তেন । ‘
সার্জেন্ট এগিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে প্রশ্ন করলো ।
—‘ আমার নাম…….. আলবার্ট আইনস্টাইন । পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী । ‘
লাবণ্য হা করে তাকিয়ে আছে । কি বলে ছেলেটা ! পাগল নাকি ?
ট্রাফিক সার্জেন্ট লাবণ্যকে বললো –
‘ ম্যাডাম ! মাথায় আঘাত পেয়েছে বোধহয় । কপালের চামড়া কেটে গেছে । আঘাত বোধহয় গুরুতর……..! দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। উল্টা পাল্টা বকছে। গাড়ীর বিরুদ্ধে মামলা দিলাম একটা । যদিও ড্রাইভারের দোষ না। উপায় নাই । গাড়ির নাম্বারটা টুকে রাখলাম । দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান ! ‘
সার্জেন্ট চিৎকার করে বললো –
–‘ সবাই চলে যান। ভীড় করছেন কেন ? বাংলা সিনামা পাইছেন ! ”
ছেলেটা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি জানি বলছে !
লাবণ্যের মেজাজ খুব খারাপ ।কষে একটা চড় মারতে ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে। রশীদ গাড়িটা নিয়ে কেটে পড়লে এই উটকো ঝামেলায় পড়া লাগতো না !
———-
বিকাল সাড়ে পাঁচটা । উত্তরা আজমপুর বাস স্ট্যান্ডের সামনে ঘটনাটা ঘটলো। লাবণ্য অফিস থেকে ফিরছিলো । ছেলেটা এখন চুপ করে লাবণ্যের পাশের সিটে বসে আছে । হা করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । যেন ঢাকা শহর কোনদিনই দেখে নাই ।
—‘ আফা ! উনি ভঙ্গ ধরছে । ঘেডি ধইরা গাড়ির থাইকা নামাইয়া দেন । অনেকদূর চইলা আইছি আমরা । অহনে সার্জেন্ট কেন্ , সার্জেন্টের বাপেও ধরবার পারবো না আমগোরে । না নামতে চাইলে আপনি জোরে একটা চিক্কুর (চিৎকার) দিবেন। আমি গাড়ি স্লো করলাম । পাবলিক আইলে কইবেন নেশাখোর মনে হয় ! আচমকা গাড়িতে উইঠা লিফট চাইতাছে । পাবলিকের ডলা খাইলে নাম, বাপের নাম সব ফরফর কইরা কইয়া দিবো। ‘
—‘ রশীদ ! তুমি কি চুপ করবা ! ‘
রশীদ দাঁত বের করে বলতেই থাকলো
—‘ আফা গো ! এডি ছিনতাইয়ের নতুন টেকনিক । গাড়ির সামনে হঠাৎ কইরা লাফ দিয়া পড়বো……..একটু ব্যাথা পাইবো, লিফট দিবেন – একটু পরেই চাক্কু বাহির করবো ………..! আমি তো চাক্কুর ডরেই পেশাব কইরা দিমু ! নতুন চাক্কু হইলে ডর নাই , তয় ওগো চাক্কু পুরান চাক্কু । জং ধরা ! গায়ে লাগামাত্র ধনুষ্টংকার হইয়া যায় ।
ঐ মিয়া ! ঐ….. নামেন ! গাড়ি থাইকা । ‘
লাবণ্য ছেলেটার দিকে তাকালো । ছেলেটা নির্বিকার ভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে ! কোন কথাই তো শুনছে না। আপন মনে বাচ্চাদের মত তাকাচ্ছে এদিক সেদিক । মাথার ক্ষতস্থান থেকে সামান্য রক্ত পড়ছে ।
লাবণ্য ছেলেটার ফাইলপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করলো কিছুক্ষন । কিছু জটিল সমীকরণ , অংক দিয়ে ভর্তি ফাইল। এক কোণায় লেখা আলবার্ট আইনস্টাইন ।
লাবণ্য মুচকি হাসলো …….! সন্ধ্যার পড়ন্ত রোদের অালোয় মেয়েটাকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ।
রশীদ একটু পরপর তার পান খাওয়া লাল লাল দাঁতগুলো বের করে হাসছে ।
—‘ রশীদ আমি কিন্তু সত্যিই তোমাকে চড় মারবো । গাড়ি নিয়ে সোজা ঢাকা মেডিকেলে চলো । ‘
———-
এক চ্যাঙরা টাইপের ডাক্তার হা করে সিটি স্ক্যান রিপোর্ট দেখছে । আইনস্টাইনকে ড্রেসিং করা হয়েছে ।
ডাক্তারের চোখেও মাইনাস পাওয়ারের চশমা । মোটা গ্লাস। মনে হয় সেভেন আপের দুইটা বোতলের তলার মোটা দুইটা গ্লাস ডাক্তারের দুই চোখে লাগানো। মনে হচ্ছে মাইনাস ফাইভের উপরে পাওয়ার দুইচোখেই ।
ডাক্তার অনেক্ষন সিটি স্ক্যান দেখে লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো –
‘ সিটি স্ক্যান তো নরমাল ! ওনার উল্টাপাল্টা বকার কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছিনা । প্রোবাবলি উনি মানসিক রোগী , সিজোফ্রেনিক । ‘
লাবণ্য চোখ কপালে তুলে বললো –
‘ মানে ? ‘
—-‘ মানে উনি পাগল । নিয়ে যান ওনাকে । যদি বমি করে বা খিঁচুনী হয় নিয়ে আসবেন !
ভাই !…….. ও আইনস্টাইন ভাই ! বাড়ির ঠিকানা মনে আছে ? ‘
ছেলেটা বিড়বিড় করে বললো –
‘ সময় এখানে চতুর্থ মাত্রা , মানে ফোর্থ ডাইমেনশান হিসাবে কাজ করছে । এপ্লাইড ফিজিক্স বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । ‘
ডাক্তার হেসে লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন – ‘ ম্যাডাম ! প্রোবাবলি উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ! সাবকনশাস মাইন্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছেন। ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে একটু দেখতে পারেন । অবশ্য এখন সন্ধ্যা সাতটা । ডিপার্টমেন্ট বন্ধ । কাউকেই পাবেন না ।’
—‘ আপনার নাম্বারটা কাইন্ডলি একটু দেবেন ডক্টর । বিপদে পড়লে একটা ফোন দেব……… ‘
—–‘ দু:খিত ! আমার মোবাইলটা আজকে চুরি হয়ে গেছে । একটু আগে । টেবিলে রেখেছিলাম । এসে দেখি নাই ! হা হা হা ! ‘
লাবণ্যের আজ সবাইকে কেন জানি চড় মারতে ইচ্ছা করছে । এই আঁতেল ডাক্তারটাকেও । মোবাইল হারিয়ে দাঁত বের করে হাসছে । স্টুপিড একটা । ড্রাইভার রশীদ টা কোথায় গায়েব হয়ে গেল !
———
শাহবাগ থানার অসি সাহেব লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে বললেন -‘ ঠিক বুঝলাম না ! উনি আপনার গাড়িতে আঘাত পেয়েছেন উত্তরা আজমপুরে । জিডি বা মামলা উত্তরা থানা নেবে । এখানে কেন ? ‘
—‘ জ্বী ! ছেলেটা মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এপ্লাইড ফিজিক্সের ছাত্র ! একটু হেল্প করুন প্লিজ ! ‘
—-‘ ম্যাডাম ! রাত আটটা বাজে । নাম ঠিকানা জানেন না ছেলেটার। কোন ডিপার্টমেন্ট তাও আপনি কনফার্ম না ! ওনাকে আপনি থানায় রেখে যান । আমরা দেখি চেষ্টা করে……..! ‘
–‘ থানায় কোথায় থাকবে ও ? ‘
—‘ আপাতত হাজতে । ‘
—‘ কি বলছেন ! সে তো চোর ও না ডাকাত ও না ! ‘
—‘ তাহলে দু:খিত ম্যাডাম । ওর ছবি তুলে রেখেছি । যোগাযোগ করবো যদি ট্রেস করতে পারি ।
অ্যাই ছেলে অ্যাই ……! নাম কি তোমার ? ‘
—-‘ আইনস্টাইন । আলবার্ট আইনস্টাইন । ম্যাসাচুয়েস্ট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি । এম আই টি । যুক্তরাষ্ট্র । ‘
লাবণ্যর চোখে পানি । তার মানে ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের না !
ওসি সাহেব উত্তরা থানাতে ফোন দিলেন লাবণ্যর সামনেই । বললেন – কেউ কোনো হারানো ছেলের খোঁজ করতে আসলে যেন লাবণ্যকে অথবা তাঁকে ফোন দেয়া হয় । ওসি সাহেব নিজেও লাবণ্যের নাম্বারটা টুকে রাখলো ।
লাবণ্য উঠে দাঁড়ালো । ছেলেটাকে নিয়ে কিছু খাওয়া দরকার । ক্ষিধা পেয়েছে প্রচন্ড !
——-
রাত আটটা তিরিশ ।
লাবণ্যের ফোন বাজছে । মামী ফোন দিয়েছেন ।
—‘ কি রে লাবণ্য ! তুই নাকি কোন পাগল ছাগলকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করতেছিস ! রশীদ ফোনে বললো ! পাগলটাকে পাঁচশো টাকা দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে সোজা বাসায় চলে আয় । যত্তোসব ! ‘
—‘ মামী ! ছেলেটাকে আজ রাতের জন্য আমাদের বাসায় রাখা যায়না ? ‘
—-‘ তুই কি !! পাগল ? পাগলছাগল নিয়ে আমার বাসায় উঠবিনা । খবরদার ! ‘
রশীদ হারামীটা দাঁত বের করে হাসছে। ছেলেটার দিকে তাকালো লাবণ্য। কিছুই খেলোনা ছেলেটা । লাবণ্যর নিজেরও কিছুই খাওয়া হলো না । একটা স্যান্ডউইচে এক কামড় দিয়েই হা করে ছেলেটা বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
ওয়েটার বিল নিতে আসা মাত্রই পকেট থেকে ছেঁড়া একটা দশটাকার নোট বের করে ওয়েটারের দিকে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল।
লাবণ্য হেসে বললো –
‘ এই যে আইনস্টাইন সাহেব ! টাকাটা ঢুকিয়ে রাখুন। আমি বেতন পেয়েছি আজ । আপনার ঠিকানা বের করি আগে, তারপর কড়ায় গন্ডায় আমার টাকা আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। ‘
ছেলেটা লজ্জা পেল মনে হয় ! একটু হাসলো …..
অদ্ভুত সুন্দর আইনস্টাইনের হাসি !
——
—‘ আফা ! রমনা পার্কের গোড়ায় নামায়া দেন হেরে। কেউ নাই এইহানে। দুইশো ট্যাকা দিয়া দেন হেরে। ভেজাল নিয়েন না গো আফা ! সারাদিন ডিউটি করতে করতে আমার মান্জা ব্যাথা হইয়া গেছে। আপদ বিদায় করেন । ‘
গাড়িটা থেমে আছে । লাবণ্য আইনস্টাইনের দিকে তাকিয়ে বললো -‘ একটু নামুন তো ! ‘
ছেলেটা চুপ করে বসে আছে ! হঠাৎ রশীদ , ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে টেনে হিঁচড়ে ছেলেটাকে নামিয়ে বললো -‘ হারমজাদা ! ভঙ্গ ধরছস ? নাম ……গাড়ির থাইকা ! ‘
ছেলেটাকে একরকম ধাক্কা দিয়েই নামিয়ে দিলো রশীদ।
গাড়িটা ফুল স্পীডে ছুটছে । ছেলেটা হা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ।
——–
—‘ এ্যাই ! রশীদ ! এ্যাই !…….. গাড়ি থামা ! ‘
—‘ কি কন আফা ! গুলশান চইলা আইছি তো ! বাসায় যাইতে আর তিন মিনিট লাগবো ! ‘
লাবণ্য হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। এত কষ্ট লাগছে কেন ওর একটা পাগল ছেলের জন্য ! অদ্ভুত এক অনুভূতি !
—-‘ আফা ! ও নেশাখোর পোলা !
দেহেন আমনের দুইশো ট্যাকা দিয়ে গাঞ্জা খাইতাছে । বদমাইশ একটা পোলা……. চাক্কুওয়ালা বদমাইশ । ‘
——
লাবণ্য সিএনজি নিলো। রমনা পার্কে যাবে । রশীদ হা করে গাড়ি থামিয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । এতো জোরে চড় রশীদ আগে কখনো খায় নাই । লাবণ্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রশীদ কে জিজ্ঞেস করলো –
‘ এ্যাই হারামী ! ও যে গাঁজা খায় তুই কিভাবে জানিস ? ‘
——–
রাত প্রায় দশটা ।
লাবণ্য পাগলের মত ছেলেটাকে খুঁজছে । কোথায় গেলো পাগলটা !
এত রাতে পার্কে ঢুকবে ও ! একটা লোক লাবণ্যের পাশে এসে বললো –
‘ কত নেন এক রাত ? ‘
লাবণ্যের রক্তাক্ত চোখের দিকে তাকিয়েই বদমাশ ব্যাটা বললো – ‘ সরি ম্যাডাম ! ‘
পাগলটা কই গেলো !
লাবণ্যের ফোন বাজছে ।
—‘ তুই রশীদ কে চড় মেরেছিস কেন ? কোথায় তুই ? ঐ পাগল কে তোর ! রাতে কৈ থাকবি ! ‘
লাবণ্যের মোবাইলে চার্জও প্রায় শেষ । লাবণ্য মোবাইল কেটে দিলো। মামীর বকবকানি অসহ্য লাগছে ওর ।
পাওয়া গেছে ছেলেটাকে । পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে আছে ।
লাবণ্য ছেলেটার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো –
‘ সরি ! সরি ! সরি ! ‘
আইনস্টাইনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।দুই আদমের অদ্ভুত সুন্দর এক আবেগের সাক্ষী হয়ে আছে ……
পার্কের সোডিয়াম লাইটগুলো ।
—–
–‘ হ্যালো সুজানা ! তোর বাসা খালি আছে ? ‘
—‘ হ্যাঁ আছে ! কেন বলতো ? ‘
–‘ আমি একজনকে নিয়ে তোর বাসায় উঠবো । ও তোদের ড্রইংরুমে থাকবে । সকালে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেব। ‘
—‘ ইনডোর ডেটিং করবি ? অসুবিধা নাই । সব ব্যবস্থাই করে দেব। আগে বল – কে এই রাজকুমার ? হঠাৎ তোকে প্রেমে ফেললো ……! এক্কেবারে ডেটিং করার জন্য পাগল হয়ে গেলি ? কৈ ! কোনদিন তো কারো নাম তোর মুখে শুনিনি ! ‘
—-‘ ছেলেটার নাম জানিনা ! ওর না ……… মাথায় একটু প্রবলেম আছে । শোন ! মোবাইলে চার্জ প্রায় শেষ আমার ! একটু হেল্প কর আমাকে প্লিজ ! ‘
—‘ কি বলিস তুই ! এত্তোরাতে পাগল নিয়ে আমার বাসায় উঠবি ! দেখ ! মজা করিস না….. নাম বল আমাকে ! ‘
–‘ সত্যি আমি ওর নাম জানিনা , ও বলে ওর নাম আইনস্টাইন । প্লিজ দোস্ত ! খুব বিপদে পড়েছি । ‘
সুজানা ঠাস করে লাইনটাই কেটে দিল । বেশ কয়েকবার ফোন দিল লাবণ্য , ফোনই ধরলো না । মানুষের বিপদে বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া যায় ।
——
রাত এগারোটা প্রায় । পার্কের বেঞ্চিতে বসে লাবণ্য কাঁদছে । এভাবে ছেলেটাকে একা ফেলে লাবণ্য কিভাবে চলে যাবে !
হঠাৎ ছেলেটা লাবণ্যের চোখ হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো । এমন অদ্ভুত স্পর্শ লাবণ্য কোনদিনও পায়নি ।
মফস্বলের মেয়ে লাবণ্য । খুব পারিবারিক শাসনে মানুষ । এত্তো সুন্দর ! তবু প্রেম জিনিসটা কখনো ই এভাবে অনুভব করেনি ।
এটা কিসের অনুভূতি ! প্রেম ? নাকি পাগলের প্রতি করুণা !
ছেলেটা অস্ফুট স্বরে বললো –
‘ মশা তো এখানে ! অনেক মশা । বিছানা করে দাও। আমি ঘুমাবো । ‘
———
রাত এগারোটা তিরিশ
ফার্মগেট , হোটেল ******

‘ জ্বী ! আমার নাম লাবণ্য। উনি আমার হাজবেন্ড । শাহেদ ওনার নাম। উনি বেশ অসুস্থ । একটু তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ । ‘
আইনস্টাইন নামক ছেলেটাকে নিয়ে লাবণ্য ফার্মগেটের একটা হোটেলে এসেছে। ওয়েটিং চেয়ারে বসেই ছেলেটা ঘুমোচ্ছে । লাবণ্যের প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে ! জীবনে কোন ছেলের সাথে হুড উঠিয়ে রিক্সাতেই চড়লো না অথচ আজ একটা পাগল কে নিয়ে রাত কাটাবে হোটেলে। তাও হাজবেন্ড পরিচয় দিয়ে !
কি করার ! কেউই তো একটু সহযোগীতার হাত বাড়ালো না । একারণেই মানুষ দিনদিন নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হচ্ছে । বিপদে আপদে কেউই এগিয়ে আসেনা।
লাবণ্য একটা নিশ্বাস ফেললো । কষ্টের নিশ্বাস !
—‘ কি ব্যাপার লাবণ্য ! এখানে , এতো রাতে ? ‘
মাই গড ! লাবণ্যের অফিসের দুই কলিগ !
( এখানে তারা এসেছিলো কিছু নিকৃষ্টতম জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে )
লাবণ্যের চোখে পানি ।
—-‘ ইয়ে ! আমার হাজবেন্ড কে নিয়ে এসেছি ! ‘
কলিগদ্বয় মুচকি মুচকি হাসছে । কি বুঝেছে কে জানে ! একজন বলেই ফেললো –
‘ হাজবেন্ড ! না কি …….!!
যেভাবে ঘুমাচ্ছে তাতে তো মনে হয় দশ পেগ গিলেছে । মাঝরাতে খেলা ভালোই জমবে ম্যাডাম লাবণ্য । অফিসে তো খুব মুড মারেন। ভাবের ঠ্যালায় কলিগদের সাথে তো কথাই বলেন না ! এক মাতালকে নিয়ে তো ঠিকই ধরা পড়লেন …… শেষপর্যন্ত ! ‘
লাবণ্য কাঁদছে….। বোবা কান্না…..
———-
লাবণ্য হোটেলের রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । মোবাইলের চার্জার ম্যানেজ হয়েছে একটা । হোটেল বয় আমজাদের চার্জার । আমজাদ মুচকি হেসে লাবণ্যকে বললো –
‘ ম্যাডাম কিছু লাগলে কইয়েন ! ‘
—‘ কি লাগবে ? ‘
–‘ এই হার্ড ড্রিংস যদি লাগে রাইতে ! বিয়ার, হুইস্কি সব কিছু এই আমজাদ দিবার পারে ! ‘
লাবণ্য হেসে বললো – লাগবেনা আমজাদ ! সকালে চার্জারটা নিয়ে যেও ! ‘
জানালা দিয়ে চাঁদের একাংশ দেখা যাচ্ছে । লাবণ্যের মামা মামী বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো !
কি বলবে বেচারী ! বলবে ! যে একটা অচেনা সুন্দর তরুণ কে নিয়ে হোটেলে আছে ?
আইনস্টাইন ঘুমাচ্ছে । অনেক মায়া লাগছে । লাবণ্য হঠাৎ ছেলেটার মাথায় হাত দিতেই ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল । একটানে লাবণ্যকে বুকের সাথে লাগিয়ে মুহূর্তেই ছেড়ে দিলো !
শুধু ইংরেজীতে বললো –
‘ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ফর্মূলাতে আইনস্টাইন যে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করেছেন – তুমি কি জান ক্যাথরিণ ? আমিই সলভ করবো এটা । আমি ই । পোস্ট ডক্টরাল থিসিসটা জমা হলেই আলোড়ন পড়ে যাবে । ম্যাসাচুয়েটসের ইতিহাসে এমন আগে হয়নি ক্যাথরিন ! পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসাবে আমার সাথে তোমার নামও ইতিহাসের পাতায় উঠবে । ‘
ক্যাথরিণ ! কে এই ক্যাথরিণ ! আর এই ছেলেটা কি এম আই টি ( ম্যাসাচিয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি)
থেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে পিএইচডি করা ?!?
——–
রাত তিনটা !
লাবণ্য আর আইনস্টাইন পাশাপাশি জানালায় দাঁড়িয়ে আছে ।
ছেলেটা বিড়বিড় করে ইংরেজিতে বলছে –
‘ বুঝলে ক্যাথরিণ ! আইনস্টাইন খুব ধূর্ত । আলোর বেগের সাথে তুলনা করে তত্ত্ব দিয়ে দিলো। কালের সংক্ষেপণ বা প্রসারণ জিনিসটা এভয়েড করে গেল। কি বুদ্ধিমান তাই না ? ‘
লাবণ্য ছেলেটাকে ইংরেজীতে বললো –
‘ তুমি কি আমাকে ( ক্যাথরিণকে ) ভালোবাসো ? ‘
–‘ না ক্যাথরিণ ! তুমি জাস্ট আমার রিসার্চ পার্টনার।
Nothing more…….. আমি বাংলাদেশে ব্যাক করবো । ওরা এই থিওরি নেবার জন্য খুব মানসিক যন্ত্রনা দিচ্ছে আমাকে । ওরা আমাকে পাগল বানিয়ে দেবে । ওরা সাদা চামড়ার বাস্টার্ডের দল । ‘
ছেলেটা একেবারে স্বাভাবিক কথা বলছে । কিন্তু স্থান , কাল , পাত্র সম্পর্কে ধারনা নেই ।
—–
লাবণ্যের ফোন বাজছে !
এত রাতে ?
ফোনে লাবণ্য প্রায় পাঁচ মিনিট কথা বললো । অাফসানের মায়ের সাথে।
ছেলেটার নাম আফসান । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড মার্কস নিয়ে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে এম আই টি থেকে এম এস, পি এইচ ডি শেষ করেছিলো । বাংলাদেশে ব্যাক করেই তার মাথায় সিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক সমস্যা দেখা দেয় ।
প্রায়ই বাসা থেকে বেরিয়ে যায় । আফসানের মা কে লাবণ্য সান্তনা দিলো – আগামী কাল সকালেই ওকে পৌঁছে দেবে মায়ের কাছে ।
একটা কথা শুনে লাবণ্যের কষ্ট বেড়ে গেলো – আফসানকে নাকি কোনো ভাবেই যুক্তরাষ্ট্র দেশে পাঠাতে চায়নি। দেশে আসার মাত্র তিনদিন আগেই ছেলেটাকে কঠোর নিরাপত্তায় ম্যাসাচুয়েটস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কেন ???
এরপর থেকেই ওর মানসিক সমস্যা । ক্যাথরিণ নামক মেয়েটা আফসানের মাকে ফোনে কাঁদতে কাঁদতে এতটুকুই বলেছিলো –
‘ They made him mad….. simply by mental torture ‘ আফসানের কাছে নাকি যেসব তথ্য ছিল তা গোটা দুনিয়ার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণাই পাল্টে দিতে পারতো ।
কি সেই তথ্য !
——-
রাত পাঁচটা । লাবণ্যের কেন জানি প্রচন্ড ভালোলাগছে …….! ছেলেটা চুপ করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্য ছেলেটার হাত আলতো করে স্পর্শ করে বললো –
‘ আফসান ! তুমি আমাকে ভুলে যাবা নাতো ? আমি আজ অনেক বড় স্ক্যান্ডালের ভাগী হয়ে গেলাম । মামা মামী , মা , অফিসের কলিগ সবাই কত্তোটা খারাপ ভাবছে আমাকে ! ‘
লাবণ্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । আফসান লাবণ্যকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো !
লাবণ্য আর আফসানের নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে…..।
লাবণ্য কি করছে এটা !!!!!!! মারাত্মক ভুল নয় তো ?!?
……………….
সকাল আটটা –
লাবণ্য ভীষণ লজ্জিত ! গতকাল রাতে …….. ছি ছি ছি !
কি হয়ে গেল এটা ? নিজের ই নিজেকে ঘৃণা লাগছে । লাবণ্যের চোখের কোণে পানি । আফসানতো মানসিকভাবে সুস্থ্য নয় । ও যদি ভুলে যায় লাবণ্য কে !!! নিষিদ্ধ এক রাতের স্মৃতি ………..!

আফসান আর লাবণ্য নাস্তা করছে। ফার্মগেটের একটা কফি শপে ।
আফসানের মা আফসানকে একটু পরই নিতে আসবেন ।
লাবণ্য আজ আফসানকে ভালোবাসে । অন্ধভাবে । আল্লাহ সাক্ষী ।
আফসান রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে ।
ফার্মগেটের ব্যস্ত রাস্তা । আফসান ও লজ্জিত মনে হয় । গাল দুটো লাল হয়ে আছে ! টমেটোর মত……..!
হঠাৎ আফসান উঠে দাঁড়িয়ে কফি শপ থেকে বের হয়ে রাস্তার ওপারে চলে গেল !
লাবণ্য চিৎকার দিয়ে বললো –
‘ থামো আফসান ! থামো ! প্লিজ ব্যস্ত রাস্তা ! ‘
আফসান রাস্তার ওপারে গিয়ে একটা ফুলের দোকান থেকে লাল গোলাপ কিনলো……. টকটকে লাল গোলাপ ! একি ! লাবণ্যের বিশ্বাস ই হচ্ছেনা !
আফসান পকেট থেকে পুরোনো সেই দশটাকার নোট বের করে – ফুলের দাম শোধ করছে । দূর থেকে হা করে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে আছে ।
লাবণ্য লজ্জায় কফির কাপে চুমুক দিলো……..!
হঠাৎ চিৎকার ! সোরগোল !
লাবণ্যের ঘোর কাটতেই তাকিয়ে দেখে রাস্তার গাড়ি সব থেমে আছে। একদৌড়ে লাবণ্য কফিশপ থেকে বের হয়ে দেখলো –
আফসানের নিথর দেহ পড়ে আছে পিচঢালা রাস্তায় । জমাট জমাট রক্তের সাথে রক্তগোলাপটাও মিলেমিশে একাকার ।
———-
২০১৫ সাল
লাবণ্য আজ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কর্মরত ।
একটা কনফারেন্সে এসেছে লাবণ্য ।
—-‘ ম্যাডাম আপনার নামটা কাইন্ডলি………..! ‘
—-‘ লাবণ্য আফসান ! হাজবেন্ড – মৃত. ডক্টর অাফসান ! ‘

লাবণ্য আর বিয়ে করেনি । করবেও না।
সবাই জানে এক পাগল কে লাবণ্য বিয়ে করেছিল । তাদের বাসর হয়েছিল……… পাগলটা বেঁচে থাকলে আজ হয়তো আইনস্টাইনের কোয়ান্টামের তত্ত্বটা টিকতো না ।
লাবণ্যের জীবনে কোন পুরুষের প্রয়োজন নেই ! এক রাতে আফসানের প্রগাঢ় ভালোবাসার কাছে পুরো পৃথিবীটাই আজ ম্লান !
লাবণ্য আজ তাবৎ দুনিয়াকে ঘৃনা করে ……. ভালোবাসে কেবল ঐ পাগলা আফসান টাকেই !

ছোটগল্পঃ লাবণ্য আর এক অচেনা আইনস্টাইন
লেখকঃ আসিফ শুভ্র

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে