দ্য ফরটি রুলস অব লাভ : পাঠ প্রতিক্রিয়া

0
দ্য ফরটি রুলস অব লাভ

বইঃ দ্য ফরটি রুলস অব লাভ

লেখকঃ এলিফ শাফাক
দ্য ফরটি রুলস অব লাভ

ভূমিকাঃ বইটির নাম দেখে অনেকেই ধরে নেবেন যে এটা একটা প্রেমের গল্পের বই (অনেকের ভাষ্যমত “লুতুপুতু প্রেম”!)। প্রেমের ব্যাপারে আপাত অনভিজ্ঞ (!) অনেক তরুণ হয়তো এই ভেবে বইটি পড়বেন “চল্লিশটা রুলের একটা দুইটা কাজে লাগাইতে পারলেই হইয়া গেল…”। কিন্তু না, আমি সেসব তরুণদের হতাশ করার জন্য দূঃখিত। এটা প্রেমের কোন বই না, যেটা কিছু সময় পরেই জানতে পারবেন। তবে এটাতে প্রেম বা ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেটা নারী পুরুষের প্রেম নয়, প্রকৃতি, সৃষ্টিকর্তা, আর মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার গল্প। এটাকে ফিলোসফিক্যাল জনরার বই বললেই বোধকরি বেশি উপযুক্ত হবে।

এলিফ শেফাকের কোন বই আগে আমি পড়িনি, কিন্তু এই বইটি পড়তে গিয়ে আমি গল্পটির এতোটাই গভীরে ঢুকে গিয়েছিলাম যে, আমি গল্পের ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহ যেমন রুমি এবং সামস এমনকি লেখিকার ব্যাপারেও জানার জন্য উইকি আর গুগলে অনেক কিছু পড়েছি। আমি যেন ভালোবাসার সংজ্ঞা নতুন করে জেনেছি, শিখেছি। ভালোবাসা নিয়ে আমার মাথায় হাজারটা চিন্তা চলে এসেছে।

তাই এটাকে রিভিউ বলাও মনে হয় ঠিক হবে না। মনোযোগী পাঠক হয়তো উপরেই লক্ষ্য করেছেন আমি বুক রিভিউ কথাটির পাশে একটা (+ +) দিয়েছি। তার মানে, আমার এই লেখাটিতে রিভিউ ছাড়াও ভালোবাসা নিয়ে অনেক কিছু থাকবে। আর তাই বরাবরের মত আমার অন্যান্য রিভিউর মতো এটাও অনেক বড় হবে। যারা শুধুমাত্র বুক রিভিউ পড়তে চান, তারা কাহিনী সংক্ষেপ এবং এর পরের কিছু প্রতিক্রিয়া পড়লেই চলবে, পরের অংশটা পড়ার প্রয়োজন নেই।

কাহিনী সংক্ষেপঃ এলা রুবেইনস্টেইন ম্যাসাচুসেটস এর নর্দাম্পটনে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে সুখী (!) জীবন কাটাচ্ছে। তার স্বামী ডেভিড একজন বিখ্যাত ডেন্টিস্ট এবং বিত্তবান একজন মানুষ। বড় মেয়ে জেনেট কলেজে পড়ে আর জমজ দুই ছেলে মেয়ে টিন এজার। চল্লিশ বছর বয়সী এলা সাধাসিধা আটপৌরে এক জীবন কাটায়। একজন ২৪/৭ গৃহিণী, যেন অনেকটা আমাদের দেশের মায়েদের মত। তার জীবন একটা নির্দিষ্ট রুটিনে চলে, যেখানে স্বামী সন্তানের দেখাশোনা আর রান্নাবান্নার কাজ ছাড়া আর কোনই বৈচিত্র নেই। সন্তানদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তবে ডেভিডের সাথে তার বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সে সুখী কি না, সেটা সে নিজেও নিশ্চিত নয়। ভালোবাসা কী, সে সেটাই জানে না বা জানতে আগ্রহী নয়।

একসময় সে উপলব্ধি করে তার সন্তানেরা বড় হয়ে গেছে, তাদের আর মায়ের সাহায্যের দরকার নেই। এলা খুবই একাকী বোধ করতে থাকে। সময় কাটানোই তার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সাহিত্যের গ্রাজুয়েট হওয়ায় সে তার স্বামীর মাধ্যমে একটা প্রকাশনা সংস্থায় লিটারেরি এডিটর হিসাবে একটা পার্ট টাইম চাকুরি নেয়। এই চাকরিটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

তার প্রথম এসাইনমেন্ট হিসাবে, তার বস তাকে “সুইট ব্লাসফেমি” নামের জনৈক ডাচ অখ্যাত লেখক আজিজ যেড যাহারা এর (তার প্রথম লেখা) একটা উপন্যাস পড়তে দেয়, যেটার উপরে তিন সপ্তাহের মধ্যে তাকে একটা প্রতিবেদন দিতে হবে যে, বইটি তাদের সংস্থার জন্য ছাপানোটা লাভজনক হবে কি না।

সুইট ব্লাসফেমি গল্পটি ত্রয়োদশ শতাব্দির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জালালুদ্দিন রুমি এবং সামস অব তাবরিজ’কে নিয়ে লেখা। যেখানে সামস সেই গল্পের প্রধান চরিত্র। তার মুখ থেকেই ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ নিয়ে চল্লিশটি রুল এবং অসংখ্য দর্শনের কথা জানা যায়। এই ভালোবাসা মানুষের প্রতি মানুষের, প্রকৃতির প্রতি মানুষের, সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের এবং সৃষ্টির উপরে স্রষ্টার ভালোবাসার কথা। এছাড়া আরো আছে রুমি এবং সামসের মধ্যকার সম্পর্কের কথা, সামসের মাধ্যমে রুমির পৃথিবীখ্যাত কবি হয়ে ওঠা এবং একসময় সামসের রহস্যময় অন্তর্ধান। যদিও গল্পের শেষে তাকে হত্যার একটা দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে, তবে তার জীবিত থাকার কথাও ইংগিত দেয়া হয়েছে।

বইটি পড়তে গিয়ে এলা যেন সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতের সাথে পরিচিত হয়, যেটার ব্যাপারে তার কোন ধারণাই ছিল না। ভালোবাসা কী, এটা যেন সে নতুন করে উপলব্ধি করে। সে লেখকের ব্যাপারে প্রচণ্ড কৌতূহলী হয়ে পড়ে এবং কাজটা কোম্পানির নীতি বিরুদ্ধ হলেও সে সেই লেখকের কাছে একটা ইমেইল পাঠায়। এর পরে সে তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে থাকে। এলার কাছে লেখককে মনে হয় ২০০৮ সালের সামস অব তাবরিজ! সে তার প্রেমে পড়ে যায়। এবং এক পর্যায়ে তার স্বামী এবং পরিবার ছেড়ে বোহেমিয়ান জীবন বেছে নেয়, আজিজের সাথে সে সেই রুমি আর সামসের দেশ তুরষ্কের কোনিয়ায় চলে যায়, যেখানে আজিজের মৃত্যু হলে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সেখানে দাফন করে। এলার জীবনে আর কিছুই রইল না, তার কাছে কোন টাকাও নেই। কিন্তু সে আবার তার পরিবারে ফিরে যাবে না, যেখানে ভালোবাসা নেই। সে সামসের বা আজিজের দর্শন অনুযায়ী, তার হৃদয় যেটা চায়, সেভাবেই “আজকের দিনটি” হিসাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে।

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ বইটির রিভিউ লিখতে গিয়ে আমিও যেন এলার মত ভালোবাসাকে অন্যভাবে দেখতে পেয়েছি, তাই এই বইটির প্রভাবে পড়ে আমার মনের ভাবনাগুলো আমি “ভালোবাসার চক্র” নামে একটা আলাদা লেখায় রিভিউটির নিচে প্রকাশ করেছি। তবে প্রথমে এই বইটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলতেই হয়।

প্রথমেই, তুরষ্কের লেখক এলিফ শাফাকের মত এতো প্রতিভাবান একজন লেখিকার বই আমি কেন আগে কখনো পড়িনি সেটা নিয়ে বেশ আফসোস হচ্ছে, তাই এটা শেষ করার সাথে সাথেই আমি দ্য বাস্টার্ড অব ইস্তাম্বুল” পড়া শুরু করেছি। আমি বইটা পড়ছি অবাক এক বিস্ময় নিয়ে। শুধুমাত্র কাহিনী নয়, লেখিকার সামর্থ নিয়ে, বিভিন্ন সময়ের কাহিনীর ব্লেন্ডিং নিয়ে। ত্রয়োদশ (১২৪২-১২৬০) শতাব্দির ইতিহাসের সুফি/ কবি রুমি আর বোহেমিয়ান দারবিশ তাবরিজের সামস এর জীবনের সাথে আধুনিক যুগের (২০০৮) এক আমেরিকান নারী এলা আর আরেক ডাচ বোহেমিয়ান পুরুষ আজিজের কাহিনী, যেন তিনটি গল্প একত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবছি আমি কি “ফর্টি রুলস অফ লাভ” পড়ছি নাকি “সুইট ব্লাসফেমি” নাকি অন্য কোন বই! বইটি কি এলিফ শাফাক লিখেছেন নাকি আজিজ যাহারা ! দুইটা সময়ের গল্প পাশাপাশি এগিয়ে যাওয়ার গল্প আগে যে পড়িনি তা নয় (আমি নিজেই এ ধরণের একটা উপন্যাস লিখছি), কিন্তু তবুও আমার মনে হয়েছে, আমি সম্পুর্ণ একটা ভিন্ন ধাঁচের লেখার সাথে পরিচিত হলাম।

এলার সাথে ডেভিডের বিবাহিত জীবনটা যে সুখের নয় সেটা তিনি চমৎকার একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেনঃ

‘…গত ভ্যালেন্টাইনস দিবসে তার স্বামী তাকে একটা হৃদয়ের আকৃতির হীরার পেনডেন্ট উপহার দিয়েছিল, যেটার সাথের কার্ডটায় লেখা ছিল “আমার প্রিয়তমা এলা’কে; এমন একজন মহিলা যার আচরণ চমৎকার, হৃদয়টি অনেক বড় এবং যার একজন দেবতার মত ধৈর্য রয়েছে। আমি যেমন, সেভাবেই আমাকে গ্রহণ করে নেয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমার স্ত্রী হওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার, ডেভিড”। এলা কখনোই এভাবে ডেভিডের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেনি, কিন্তু কার্ডটা পড়ে তার মনে হলো, সে যেন একটা মৃত্যু সংবাদ পড়ছে, যেটা কবরে রাখার আগে কোন মৃতের উদ্দেশ্যে পড়া হয়। আমার মৃত্যুর পর এমনই কিছু একটা লেখা হবে, সে ভাবল…”

সামস এ তাবরিজ এবং জালালুদ্দিন রুমি ইতিহাসের চরিত্র। তারা সুফিসাধক ছিলেন। তবে দারবিশ হিসাবে পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেও ইতিহাসেও সামসকে এক রহস্যময় পুরুষ হিসাবে বলা হয়েছে। কিন্তু তার দর্শন হিসাবে যে ভালোবাসার চল্লিশটি রুলের কথা বর্নণা করা হয়েছে, সেগুলি নিঃসন্দেহে লেখিকারই লেখা। আসলেই, সবাই যদি এই রুলগুলো নিজের জীবনে ধারণ করতে পারত, পালন করতে পারতো, সবার চোখে ভালোবাসার আসল রূপটা উন্মোচিত হতো। পৃথিবী থেকে হিংসা, বিদ্বেষ চিরতরে বিদায় হতো, পৃথিবীটা ভালোবাসায় ভরা একটা জায়গা হয়ে উঠত।

রুলগুলো বেশ বড় বড়, তবে প্রতিটিতেই ভালোবাসার এক ভিন্ন বার্তা দেয়া হয়েছে। সবগুলো রুল এই স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব না, তবে শেষ রুলটি এরকমঃ

“ভালোবাসা ছাড়া একটি জীবনের কোন মূল্যই নেই। তোমার কোন ধরণের ভালোবাসা প্রয়োজন; আধ্যাত্বিক নাকি ব্যক্তিগত, স্বর্গীয় নাকি জাগতিক, পশ্চিমা নাকি প্রাচ্যিয় – সেটা জিজ্ঞেস করো না। বিভেদ শুধুই আরো বিভাজন তৈরি করে। ভালোবাসার কোন নাম নেই, কোন সংজ্ঞা নেই। এটা সে রকমই, যে রকম তুমি দেখছ, এর কম/বেশি আর কিছুই নয়।“

সবশেষে আমি বলব, আমার জীবনের অন্যতম সেরা একটা বই পড়েছি। জীবনকে দর্শন এবং মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে উপলব্ধি করার চমৎকার এক গল্প। এক অসাধারণ রচনা।

দ্য ফরটি রুলস অব লাভ।

হ্যাপি রিডিং 😍😍😍
=========================================
ফরটি রুলস অব লাভ বইটি পড়তে গিয়ে এর প্রভাবে পড়ে ভালোবাসা নিয়ে কিছু ভাবনা আমার মাথায় চলে আসে, এখানে সেটাই দিলাম। এটা না পড়লেও ক্ষতি নেই।

ভালোবাসার চক্র
============

পরিবার, বন্ধন, ভালোবাসা…

ভালোবাসার চক্রের শুরুটা পরিবার থেকেই হয়। পরে সেটা গন্ডি ছাড়িয়ে আত্মীয় এবং বন্ধুদের সাথে গিয়ে মিশে, সবাই এক অদৃশ্য মাধ্যমে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে যায়, জীবন এগিয়ে চলে – ভালোবাসার এক অপূর্ব বন্ধনে!

ভালোবাসার শুরুটা জীবনের প্রথম দিনটি থেকেই হয়, জন্মের পর মূহুর্তেই। প্রথম দিন থেকেই কী? তারও অনেক আগে থেকে নয়? কারণ আপনার আমার সৃষ্টিটাই তো আমাদের বাবা-মায়ের ভালোবাসার ফসল! সৃষ্টিকর্তা কী চমৎকারভাবে আমাদের “সৃষ্ট’ হওয়ার উপায় নির্ধারণ করেছেন! আমরা ভালোবাসার সৃষ্টি, ভালোবাসার মাঝে বেড়ে উঠি, ভালোবাসার মধ্যে জীবনটা কাটিয়ে দেই, একসময় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই অসীম এই ভালোবাসার পৃথিবীর মেয়াদ শেষ হয়, আমাদের প্রিয়জনরা পরম ভালোবাসায় আমাদের শেষ নিদ্রায় শুইয়ে দিয়ে আসেন… যেন একটা চক্র পূর্ণ হলো, ভালোবাসার চক্র!

আমাদের নিজের জন্মটা আমার মা, বাবা, পরিবারের কাছে কতটা আনন্দের একটা ঘটনা ছিল, আমরা সেটা দেখিনি, তাই বুঝি না। কিন্তু নিজ সন্তানের কিংবা কোন আত্মীয়, বন্ধুর সন্তানের জন্মের সময় সেটা আমরা দেখি, কতো আনন্দময় একটা ঘটনা! জন্ম থেকেই আমরা ভালোবাসা পেতে শুরু করি, ভালোবাসার চক্রটা শুরু হয়ে যায়।

এরপরে ভাইবোনদের সাথে, মা-বাবার অবাধ ভালোবাসায় আমরা বড় হয়ে উঠতে থাকি, আশেপাশের বন্ধু, আত্মীয়দের ভালোবাসাটা দেখতে থাকি, আমাদের মধ্যেও ভালোবাসার সংস্কৃতিটা গড়ে উঠতে থাকে, ভালোবাসার বীজটা রোপিত হয়ে যায় – আপনাতেই। আমরা অন্যকে ভালোবাসতে শিখি।

একসময় ভালোবাসাটা রেসিপ্রোকাল বা পারস্পরিক বিনিময়ের বিষয় হয়ে ওঠে। কৈশোর বা তারুণ্যের গতিময় বাঁধভাঙা দিনগুলোতে, স্কুল কলেজে পড়ার সময় কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর অসুস্থতায় আমরাও একইরকম চিন্তিত হই, তার সুস্থতার জন্য নিজের আরাম আনন্দের কথা ভুলে গিয়ে সর্বক্ষণ তার পাশে বসে থাকি, চিন্তিত থাকি, তার প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে চেষ্টা করতে থাকি। একইভাবে তার কোন এক সফলতায় একইরকম উচ্ছ্বাস আমাদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।

ফেসবুকের জগতে বিভিন্ন গ্রুপে আমি সেই ভালোবাসার বিভিন্ন রূপটা যেন পরিষ্কার দেখতে পাই। ভার্চুয়্যাল বন্ধু, ভার্চুয়্যাল ভালোবাসা! আমার মনে হয় বন্ধুটি ভার্চুয়্যাল হতে পারে, ভালোবাসাটা ভার্চুয়্যাল নয়, এটা প্রকৃত ভালোবাসার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বরঞ্চ জগতটি ভার্চুয়্যাল হওয়াতে এটার গন্ডি বহুদূর, এটার পরিসীমা অনন্ত। আমার বন্ধুটি কোথায় আছে না জানলেও তার সুখের, আনন্দের কথাটির মতো তার কষ্টের, দুঃখের কথাটি আমি মূহুর্তেই জানতে পারছি। আমিও তার আনন্দের বা কষ্টের অংশ হয়ে যাচ্ছি। কী চমৎকার একটা ব্যাপার! যেন একটা পরিবার, যাদের সবাই সেই এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে রয়েছে!

একসময় অবধারিতভাবে, আমাদের জীবনে একজন ভালোবাসার মানুষ আসে। সেটা সম্পূর্ণ অন্য এক ধরণের ভালোবাসা। আসলেই কি তাই? সব ভালোবাসার রূপ কিন্তু একই। যার সাথে আপনার জীবনটা কাটাতে যাচ্ছেন তার প্রতি ভালোবাসা। এখানেও ভালোবাসাটা রেসিপ্রোকাল। আপনিও আপনার ভালোবাসার মানুষটা থেকে একই প্রকার ভালোবাসা পেয়ে থাকেন। অনেকে হয়তো বলবেন, তিনি তার জীবনে প্রেমে পড়েননি। কিন্তু আপনার জীবন সঙ্গী/সঙ্গীনির সাথে আপনার ভালোবাসার সম্পর্ক অবশ্যই আছে। কারো কারো কাছে সেটা দৃশ্যমান নয় বা তার প্রকাশের ভঙ্গিটা অন্যরকম। অবশ্য খুব কম একটা সংখ্যক মানুষ প্রকৃতির এই বন্ধনে জড়িত হন না, তারা বিয়ে নামক বন্ধনে জড়িত হতে চান না, কিন্তু তাদের জীবনেও কিন্তু ভালোবাসা আসে। আসতেই হবে – এটাই প্রকৃতির নিয়ম! আপনার সঙ্গী সঙ্গিনীর সাথে ভালোবাসার ফলস্বরূপ আপনাদের সন্তান আসে, ভালোবাসার চক্রটি পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়।

অবশেষে, ভালোবাসার চক্রটি পূর্ণ হতে আরেকটি অধ্যায় বাকি রয়ে গেল। জীবনে শুধু ভালোবাসা পেয়েই গেলাম, কিছুটা হয়তো দিয়েছিও কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দান, সেটা এখনো বাকি রয়ে গেছে।

যেই মা-বাবার কারণে আমরা পৃথিবীর আলো দেখেছি, তাদের ভালোবাসা পেয়ে আজ এ পর্যায়ে এসেছি, তারা এখন বৃদ্ধ, নিজে থেকে কিছু করতে পারেন না, তাদের জীবন এখন নির্দিষ্ট একটা গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ, তাদের সর্বক্ষণ সমর্থণ দরকার। ঠিক এই সময়ে তাদের একমাত্র যে জিনিসটার দরকার, সেটা হলো ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা, যেটা তারা আমাদের শিশুকালে দিয়েছিলেন!।

এবং সৃষ্টিকর্তাই আমাদেরকে সেটা করার জন্য আমাদেরকে তাগিদ দিয়েছেন। পবিত্র কুর’আনে (এমনকি অন্যান্য প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থেও এ ব্যাপারে প্রায় এধরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে) কতো সুন্দরভাবে লেখা আছে, “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ঈয়ানী সাগিরা।“ হে আল্লাহ্‌ আমার মাতা-পিতার প্রতি আপনি সেই ভাবে সদয় হউন, তাঁরা শৈশবে আমাকে যেমন স্নেহ-মমতা দিয়ে লালন-পালন করেছেন।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা প্রায় সবাই এটা স্বতস্ফুর্তভাবেই করে থাকি, যদিও কিছু ক্ষেত্রে ভীষণ অসামাঞ্জস্যতা দেখা যায়। তবে সেগুলোকে “ব্যাতিক্রম” ভেবে নেয়া যেতে পারে, তাই সেসব নিয়ে আলোচনার কোন অর্থ হয় না। তবে আমরা যদি আমাদের মা-বাবার প্রতি সেই ভালোবাসাটা ফিরিয়ে দিতে না পারি, আমাদের সন্তানেরা আমাদের কাছ থেকে দেখে যেটা শিখবে, আমরা যখন ঐ পর্যায়ে যাবো তখন আমাদের সাথেও ওই ধরণের আচরণই করবে।

পৃথিবী ভালোবাসাময় হোক, পুরো পৃথিবীর সকল মানুষ একটি পরিবারের মত ভালোবাসার বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে যাক!

সবার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।

পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ বদরুল মিল্লাত

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে