শঙ্খনীল কারাগার : পাঠ প্রতিক্রিয়া

0
শঙ্খনীল কারাগার

বইঃ শঙ্খনীল কারাগার
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৭২ সাল
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৬৮
রেটিংঃ ৪.৭৫/৫
শঙ্খনীল কারাগার

নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে তাঁর মতো জনপ্রিয় লেখক কেউ নেই। স্বল্প পরিসরে লেখা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তাঁর সবচেয়ে অনন্য সাধারণ উপন্যাসিকা। শুধু তাঁরই নয়, বরং এটি গোটা বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য একটি উপন্যাসিকা। বইটার নাম তিনি কবি রফিক কায়সারের কবিতা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এর নামে দেন। তিনি সোমেন চন্দ্রের লেখা “ইঁদুর” ছোটগল্প পড়ে মধ্যবিত্তদের জীবন নিয়ে গল্প লিখতে উৎসাহিত হন। যার ফল “শঙ্খনীল কারাগার” ও “নন্দিত নরকে”। “নন্দিত নরকে” তাঁর প্রকাশিত ১ম উপন্যাস হলেও “শঙ্খনীল কারাগার” তাঁর লেখা ১ম উপন্যাসিকা। এরপরে তাঁর আড়াইশো’রও অধিক সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। তবে আমি মনে করি তাঁর কোনো বইই সাহিত্যগুণে “শঙ্খনীল কারাগার”কে অতিক্রম করতে পারে নি।

*** খোকা(কথক), রাবেয়া, মন্টু, রুনু, ঝুনু, কিটকি, নিনু, ওভারশীয়ার কাকু, সুহাসিনী মাসি, শিরিন সুলতানা(খোকার মা), খোকার ছোটখালা, খোকার বড়মামা, মনসুর, আজহার হোসেন(খোকার বাবা), আবিদ হোসেন(রাবেয়ার আসল বাবা)।

*** উপন্যাসিকাটির কথক ‘খোকা’। তারা ছয় ভাইবোন। তার বড় বোন রাবেয়া। তার বাবা আর রাবেয়ার বাবা ভিন্ন দুই ব্যাক্তি। রাবেয়ার মায়ের আগে এক ধনীর সাথে বিয়ে হয়েছিল। সেই পরিবারে জন্মায় রাবেয়া। রাবেয়ার বাবার সাথে রাবেয়ার মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। রাবেয়ার মায়ের বাবার বাড়ি অভিজাত শ্রেণীর। রাবেয়ার মায়ের জীবন, রূপলাবণ্য সবই ছিল বড়লোকি। তিনি ভালো গান করতে জানতেন। তাঁর বাবার বাড়ি আশ্রয় নেন গরীব শিক্ষার্থী আজহার হোসেন। একদিন তিনি রাবেয়ার মায়ের মুখে গান শুনে তাঁর প্রেমে পড়ে যান। তার কয়েকমাস বাদে রাবেয়ার মায়ের সাথে বিয়ে হয় তাঁর। রাবেয়ার মা তাঁর বাবার বাড়ির সবকিছু ছেড়ে আজহার সাহেবের সংসারে যান। দীর্ঘ ২৩বছরের সংসারে একে একে খোকা ও তার বাকি চার ভাইবোন জন্মায়। সবচেয়ে ছোট মেয়ে নিনুর জন্মের সময় মারা যান খোকার মা। খোকার মা যেহেতু জন্মগত অভিজাত শ্রেণীর এবং খোকার বাবা যেহেতু দরিদ্র ঘরের ছেলে সেহেতু খোকার মায়ের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ হতো না। তবুও তিনি পছন্দ এবং সম্মান করতেন তাঁর স্ত্রীকে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী থাকতেন চুপচাপ, গম্ভীর। রাবেয়া ছাড়া তাঁর অন্যান্য সন্তানরাও তাঁর স্নেহ পায়নি তেমন। আসলে তাঁর মনে খুব দুঃখ থাকতো লুকিয়ে। সেজন্যই গানপাগলী হয়েও তিনি সংসারে ২৩ বছরের জীবনে আর কখনও গান করেন নি। খোকা তার ছোটখালার মেয়ে কিটকিকে ভালোবাসতো। কিটকিও খোকাকে ভালোবাসতো। কিন্তু তারা সপরিবারে পাঁচবছরের জন্য ম্যানিলায় যায়। সেখান থেকে একসময় ফিরে আসে ঠিকই, কিন্তু তাঁর সাথে খোকার বিয়ে হয় না। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনী। তবে কাহিনীর পরতে পরতে গভীর বিষাদ পরিলক্ষিত হয়। খোকার ছোটবোন রুনু বিয়ের আসরে বসলেও তার বিয়া হয় না মনের মানুষের সাথে। সে দুঃখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। রাবেয়ারও বিয়ে হয় না। কারণ তার গায়ের রং কালো। খোকার ছোট ভাই মন্টু লেখাপড়ায় অমনোযোগী। কিন্তু সে একজন কবি। তার চমৎকার সব কবিতা ছাপা হতো পত্রিকায়। এভাবেই দিন চলে যেতে থাকে তাদের। কাছের মানুষগুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। রাবেয়া শহরের এক মহিলা হোস্টেলের সুপারিন্টেনডেন্ট হয়ে পরিবার থেকে কিছুটা দূরে চলে যায়। মন্টুও তার সদ্য যৌবনের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর খোকা ক্রমেই পুরানো দিনের প্রাচুর্যতার স্মৃতি অন্তরে জমিয়ে রেখে নিঃসঙ্গতার বেদনায় ডুবতে থাকে।

** নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন কখনোই চিরস্থায়ী আনন্দের আশ্রয়স্থল হতে পারে না। এর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে দুঃখ, বেদনা, হারানোর ভয়, শূন্যতার আর্তনাদ, নিঃসঙ্গতার হাহাকার। সেখানে সুখ দুঃখ আসে পালাক্রমে। নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন মানুষকে নিয়ে পাশা খেলতে ভালোবাসে। কখনো পাশার দানে হারিয়ে দেয় আবার কখনো সমৃদ্ধশালী করে। সেজন্যই নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন সবসময়ই আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। যখন কেউ নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকে তখন তার পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যায়, যা ছিল পূর্ণতায় ভরপুর। যখন সে শূন্যতার হাহাকারে ভুগতে থাকে তখন তার মধুর স্মৃতি বেদনাবিধুর চাপা আর্তনাদ করে ওঠে। উপন্যাসিকাটি যৌনতা বহির্ভূত। দরিদ্র মধ্যবিত্তদের জীবনীগাঁথা যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে খোকার জবানীতে। চরিত্র-চিত্রন সার্থক হয়েছে। প্লট নির্বাচনটাও ছিল অসাধারণ। চারপাশে এত লোকজন থাকা সত্ত্বেও খোকা সেভাবেই নিঃসঙ্গতা অনুভব করে যেভাবে কারাগারে বন্দীরা নিঃসঙ্গতায় ভোগে। পরিশেষে নামটাও উপন্যাসিকার প্রতিনিধিত্ব করেছে। সার্থক নামকরণে ভূমিকা রেখেছে উপন্যাসিকার এই প্লট।

পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ রাশেদুল আলম অভি

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে