বইঃ আরশিনগর
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
গত কয়েকবছর ধরেই শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ এর না ফেরার দেশে চলে যাবার পর আমি বেশ কয়েকজন লেখক এর নাম প্রচুর শুনতে শুরু করেছি। হয়ত উনারা আগেও লিখতেন, কিন্তু আমি চিনতাম না – এ আমার দোষ। সেসব লেখকদের মধ্যে সাদাত হোসাইনের নাম বেশ উল্লেখযোগ্য। বইপোকাদের গ্রুপগুলতে প্রায়ই দেখি তাঁর মোটা মোটা বইগুলো নিয়ে ছবি পোষ্ট হচ্ছে। প্রতি বইমেলাতে তাই বইগুলো ছুয়ে দেখতাম স্টলে গিয়ে, আর দাম জিজ্ঞেস করতাম। গ্রুপে প্রায়ই চোখ রাখতাম বইয়ের রিভিউ এর জন্য। খুব কম রিভিউ দেখেছি, যা দেখেছি তাঁর বেশিরভাগই রিভিউ না, বরং অনেকটা কপি পেস্ট করে গল্পের কিছু অংশ; এর পরেই রেটিং ১০/১০। আর একটা রিভিউ দেখেছিলাম, সেটাতে তাকে গরিবের হুমায়ুন বলা হল। আরেকজনকে দেখেছিলাম বলতে যে, উনার লেখায় আবেগ খুব বেশি; উনার লেখার রেসিপি হল একমুঠো হুমায়ুনের স্টাইল, রোমান্স ১০ চা চামচ নিয়ে তাঁর মধ্যে এককাপ আবেগ ঢেলে দিন (আবেশ ঘন হতে হবে) তারপর ঘুটা দিলেই হয়ে যাবে সাদাত হোসাইনের বই। হয়ত পুরোপুরিভাবে বলতে পারিনি, কিন্তু কথাগুলো ছিল এরকমই। বইয়ের সারবস্তু কি, তা অজানাই ছিল গতকাল আশা পূর্ন হল, পড়ে ফেললাম, “আরশিনগর”।
গল্প সংক্ষেপঃ বইয়ের গল্প নির্দিষ্ট কাউকে নিয়ে গড়ে উঠেনি, বরং একই সাথে অনেকগুলো মানুষকে নিয়ে গল্প এগিয়েছে। বইয়ের নাম অনুযায়ী আরশি নামের মেয়েটার সাথে তাঁর বাবা মজিবর, স ৎ মা লাইলি , শুকরঞ্জন ডাক্তার, আশিষ ও মিলি, ইমাম, হাওলাদার পার্টি, লোকমান, বশীর, এবং উৎসুক জনতা (সরি, ট্রল করতে সামলাতে পারলাম না) —- মোটকথা, প্রচুর চরিত্রের সমাগম হয়েছে। আরশি কিভাবে মা মরা অবলা মেয়ে থেকে জীবনের নৌকায় উঠতে পারে, সেটাই অবশ্য মূল প্লট। তাকে নানা চড়াই উৎরাই পার হতে হয় তাঁর ছোট বয়স থেকেই। সে কি পারবে জীবনে কাউকে নির্ভর করার মত?
একই সাথে, শুকরঞ্জন ডাক্তারের ছেলে আশিষ ও তাঁর স্ত্রী মিলি এর সংসারজীবনটা বিপর্যস্ত হয়ে গেল এক দুর্ঘটনার পর। মিলি হয়ে গেল পাগল। তারা কি পারবে জীবনটাকে আবার গুছিয়ে নিতে?
লাইলি কি পারবে তাঁর আশা পূর্ন করতে? লতু হাওলাদার কি পারবে তাঁর আশা পূর্ন করতে?
এরকম হাজার প্রশ্নের উত্তর আস্তে আস্তে দিতে দিতে গল্প এগুবে।
পজিটিভ দিকঃ বানান ভুল নেই বললেই চলে, ২২৫ পৃষ্ঠায় ‘সবালই’ হবে ‘সবাই’। এটা বেশ প্রশংসার দাবিদার।
এবার আসি কটা নেগেটিভ দিক নিয়ে।
(১) গল্পের শুরু থেকেই আপনি বিরক্ত হবেন একই লাইন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুবার করে লেখা দেখে।
“ক্ষতি কি? কি ক্ষতি? “জাস্ট একটা উদাহরন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত মনেই হবেনা একই লাইন খালি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখা – এটা লেখকের সার্থকতা কিনা জানিনা। তবে জিনিস্টা আমার তত ভাললাগেনি।
(২) গল্প পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, লেখক দাড়ি ( । ) দিতে খুব ভালবাসেন। যেটা একলাইনে লেখা পসিবল ছিল কিংবা একলাইনে লিখলে লাইনটা আরো সুন্দর ও শ্রুতিমধুর হত, সেটাকে তিনি তিনলাইন বানিয়েছেন।
অনেকে বলবেন, ‘শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ ও একই কাজ করতেন ত! সমস্যা কি? সমস্যা আছে। উনার একটা ছোট গল্প নিয়ে পড়ে দেখুন, একটা লাইন কখনই মনে হবেনা এক্রট্রা, বরং ছোট বাক্যের মধ্যেই একেকটা গল্প লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু সাদাত এর লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, চর্বি রয়েছে লেখায়। চর্বি মাঝেমধ্যে ভাললাগলেও সবসময় ভাললাগেনা। ফ্যাট কমালে বইটা আরো প্রাঞ্জল হতে পারত।
(৩) এই ক্ষেত্রে আমার কিছূটা মনে হয়েছে, লেখক হুমায়ন আহমেদের এই প্যাটার্নটা ফলো করেছেন। প্রতিটা পৃষ্টায় একটা না একটা গভীর উক্তি থাকবেই। লেখক পণ করেছেন একটা গভীর উক্তি তাকে দিতেই হবে, তা না হলে তাঁর গল্প লেখা হবেনা। আর হ্যা প্রতিটা চাপ্টারের শেষে একটা বিশাল গভীর উক্তি থাকবেই!! না থাকলেই বরং অবাক হবেন! দুধ ভাল শরীরের জন্য, কিন্তু গ্যালন গ্যালন দুধ ক্ষতিকারক।
(৪) গল্পের সবচেয়ে বেশি বাজে লেগেছে আমার যেই ব্যাপারটা, তা হল , একটা চরিত্রের ডেপথ নাই। একটা চরিত্র ভাললাগতে শুরু করেছে বই পড়তে পড়তে, তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হবেন আস্তে আস্তে, তারপর দুম! সেই চরিত্রের কোনো ডেপথ থেমে গেছে। আসলে ঠিক বোঝাতে পারছিনা। ধরুন, এই বইটাতে শুকরঞ্জন ডাক্তার আর ইমাম সাহেবকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, কিন্তু ইমাম সাহেব কে নিয়ে খুব কম জিনিসই জানি আমরা। অথচ, গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তিনিই। শুকরঞ্জন ডাক্তারের ক্ষেত্রেও কিন্তু একই কথা খাটে।
(৫) আর হ্যা, সবাই বলে আবেগ আবেগ দিয়ে বই পরিপুর্ন, কিন্তু কেউ বলে না সেটা পুথিগত আবেগ। বইটা পরে আপনি তেমন কিছু ফিল করতে পারবেন না চরিত্রগুলোর জন্য, খালি মনে হবে এটুকুই, আরশিকে আর কত নির্যাতন করবে লেখক? আমি আবেগ বুঝিনা বলে অনেকে দাবি করতে পারেন, কিন্তু হ্যারি পটারের স্নেইপের জন্য চোখ জলে ভরে গিয়েছিল ডেথলি হ্যালোজ এ, প্যাট্রিশিয়ার আর রবের ভালবাসা থেকে সিক্ত হয়ে গিয়েছিলাম থ্রি কমরেডস’ পড়ে, এমনকি কদিন আগেই শিন্ডলারস লিস্ট সিনেমাটা দেখে ঝরঝর করে কেদে ফেলেছিলাম —-স্বীকার করছি। তাই যুক্তি খাটবেনা।
(৬) কয়েকটা জায়গায় খুব খটকা লাগবে আপনার। যেমন, শুধু শুধু কজায়গায় বলা হয়েছে আরশির চোখে জন্মকাজল দেয়া। কথাটা খালি জায়গায় জায়গায় পাবেন। একটা মানুষ (স্বাভাবিক মানুষ) কখনই চোখের দিকে তাকায় না আগে। আগে দেখে সে কিরকম পোষাক আশাক পরে আছে, সেভাবেই বিচার করে, তাই রুবিনা ডাক্তারের কম্পাউন্ডার থেকে শুরু করে অসংখ্য জায়গায় আপনি অযথা রেফারেন্স পাবেন। কয়েক ক্ষেত্রে ঠিক আছে, কিন্তু বাকি সব ক্ষেত্রে এটা বাহুল্য ছিল। আর হ্য আরেকটা কথা, আমার ফ্যামিলিতে গায়ক গায়িকা আছেন অনেকে, অনেকে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত, রেডিওতে গানও করেছেন। তাই কিছুটা জানা আছে সেখানকার জগত সম্পর্কে। তাই আরশি, যার কিনা কোনো গানের শিক্ষা নেই, গানের গ ও জানা নেই, তার খালি একটাই গুন পুথি বলা — তাঁর গলায় কিভাবে সুন্দর তাল, লয় থাকবে? যতই সুন্দর গলা থাকুক, তাতে লাভ নেই। অথচ আরশির ক্ষেত্রে বলা হল তাঁর নাকি গলায় অদ্ভুত এক মায়াবি টান আহে , যা অপূর্ব তাই তাকে তারা রেডিওতে চায়।
থামি , আর বলতে চাচ্ছিনা । তবে আশা করছি উনার অন্য বইগুলোতে একটু ভিন্ন হবে।
বইয়ের রেটিং — ৩/১০ (এটা সম্পূর্ন আমার রেটিং, কেউ ১০ দিতেই পারেন)
হ্যাপি রিডিং!
পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ বিমুগ্ধ সরকার রক্তিম