মারগ্র্যাভ, জর্জিয়া।
মৃতপ্রায় একটি শহর। একসময় যেখানে সব কিছুই জমজমাট ছিল, হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন আসতো, যেতো। কিন্তু হাইওয়ে হওয়ার পর আর বিমান খরচ কমে যাবার পর এই শহরের পথ কেউ মাড়ায়না বললেই চলে, হাইওয়ে থেকে ১৫কিঃমিঃ দূরে বলে ম্যাপেও ছোট্ট বিন্দু বিশেষ আর কিছুইনা এই শহর। একটি পুলিশ স্টেশন, একটি বার্বার শপ, একটি রেস্টুরেন্ট আর কয়েকটি ওয়্যার হাউজ, রাস্তার দুইধারে সব্জি আর ফলমূলের চাষবাস।
শহরের একমাত্র রেস্টুরেন্টে বসে মাত্রই নাশতা খাওয়া শুরু করেছিলো লোকটি, ইনোজ ডাইনারে, বাহিরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন, মিলিটারি পদ্ধতিতে ভেতরে ঢুকল তাঁরা, এরেস্ট করা হল লোকটিকে, নিয়ে যাওয়া হল শহরের একমাত্র পুলিশ স্টেশনে। রস্ক, সুন্দরী পুলিশ অফিসার, তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হল ইন্টারগেশন রুমে, লোকটি গ্রেফতারের পর থেকে একটি কথাও বলেনি, ডিটেকটিভ প্রধান আসছেন, নাম তার ফিনলে, ২০ বছর চাকরি করেছে বোস্টন পুলিশ ডিপার্টমেন্টে, তারপর এখানে এসেছে কিছুদিন হল মাত্র, যদিও বা ডিটেকটিভ প্রধান বলা হয়, তবে এখানে ডিটেকটিভ এই একজনি।
তোমার নাম আইডি নেই, নেই কোন ক্রেডিট কার্ড, কি পরিচয় তোমার? নাম কি?
রিচার, জ্যাক রিচার। যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৩০ বছর পর প্রথম মারগ্র্যাভে ওয়্যার হাউজে একটি খুনের সন্দেহভাজন হিসেবে, এই শহরে একমাত্র বহিরাগত এখন সেই, খুন হয়েছে বৃহস্পতিবার, গ্রেফতার করা হয়েছে শুক্রবার সকাল ১১টায়। জ্যাক রিচারের ভাষ্যমতে সে ছিল আর্মি ইন্টেলিজেন্সের অফিসার, সকাল আটটায় হাইওয়ে থেকে বৃষ্টির মাঝে চার ঘন্টায় হেঁটে এই শহরে এসেছে, যাচ্ছিলো আটলান্টায়, ম্যাপের এক কোনে এই শহরের নাম দেখে মনে পড়লো তাঁর বড় ভাই এই শহরের নাম বলে বলেছিল এখানে ব্লাইন্ড ব্ল্যাক নামে একজন গিটারিস্ট ছিল, আজ থেকে ৬০ বছর আগে মারা গিয়েছে, তাঁর সম্পর্কে খোঁজ নিতেই আসা, সে খুন করেনি। ফিনলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো আসলেই সে আর্মি ইন্টেলিজেন্সে ছিল। কিন্তু শনিবার থেকে ছুটির দিন হওয়ায় সোমবারের আগে সঠিক সব কিছু জানা যাচ্ছেনা, এদিকে ভিক্টিমের জুতোর ভেতর পাওয়া গেছে একটি ফোন নাম্বার, যেটি কিনা একজন ব্যাঙ্কারের, এ শহরে সুপরিচিত লোক, হাবল তাঁর নাম, তাকেও ধরে আনা হল, দুজনকেই পাঠিয়ে দেয়া হল জেলে, জেলের ভেতর হাবলকে খুন করার চেষ্টা করা হল, কিন্তু রিচার বাঁচাল, রস্ক, সুন্দরী পুলিশ অফিসার, রবিবারের মধ্যেই জ্যাক রিচার আর হাবল্কে ছাড়িয়ে আনল, কারন তাঁর মনে হচ্ছিলো জ্যাক রিচার নির্দোষ, শুধু তাই নয়, দুইজনে প্রেমেও পড়ে গেলো, যেহেতু এখানে কোন হোটেল নেই, তাই রস্কর বাড়িতেই উঠলো রিচার, এদিকে হাবল নিরুদ্দেশ বের হবার পর থেকে, জানা গেলো দুই বছর আগেই তাঁর চাকরি নেই, রিচার মর্গে গিয়ে জানতে পারলো আসলে যাকে খুন করা হয়েছে সে তাঁর আপন ভাই। যার সাথে যোগাযোগ নেই বহু বছর, জানেও না সে কি করতো। রিচার ছয় মাস আগে আর্মি থেকে ফায়ার্ড হয়েছে, গত ছয় মাস আইডি বিহীন, ক্রেডিট কার্ড বিহীন ঘুরে বেড়িয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, উদ্দেশ্য নিজেকে উপভোগ করা, ভেবেছিলো জেল থেকে বের হয়েই আবার বোহেমিয়ান হয়ে যাবে, কিন্তু না, এখন যে এই শহরে তাঁর ব্যক্তিগত দায়িত্ব এসে কাঁধে পড়লো, জানা গেলো তাঁর ভাই জোই রিচার কোন এক তদন্তের স্বার্থেই এখানে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁকে নির্মম ভাবে খুন করা হল, এদিকে হুমকি দেয়া হল হাবলের পরিবারকে, খুন হল পুলিশ প্রধান মরিসন আর তাঁর পরিবার, নির্মম ভাবে, তাঁর অণ্ডকোষ কেটে খাওয়ানো হল তাঁর স্ত্রীকে, একই ভাবে হত্যার হুমকি দেয়া হল হাবলের পরিবারকে, কিন্তু হাবল নিরুদ্দেশ।
রিচার কি পারবে তাঁর ভাইয়ের খুনিদের খুঁজে বের করতে? আর কি উদ্দেশে তাঁর ভাই এসেছিলো এখানে? তাঁর ভাইয়ের পকেট থেকে পাওয়া লিস্টই বা কি নির্দেশ করে? কে এই স্টলার? কে এই ক্লিনার, কি কাজ তাঁর ক্লিনার ফাউন্ডেশনের? কেনইবা তাঁরা শহরের প্রতিটা মানুষকে সপ্তাহে হাজার ডলার করে দান করে? কাকে বিশ্বাস করবে রিচার? পুরো শহর তাঁর বিরুদ্ধে নয়তো?
———————————————-
লি চাইল্ড, জন্মেছেন ইংল্যান্ডে, বেড়ে উঠেছেন বার্মিংহাম শহরে, স্কুল জীবনে জড়িত ছিলেন মঞ্চের সাথে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নাট্যকলা নিয়ে না পড়ে নিয়েছিলেন আইন বিষয়। পড়ালেখা শেষ করে যোগ দেন গ্রনাডা টেলিভিশনের টেকনিক্যাল কর্মকর্তা হিসেবে, পরবর্তীতে টেলিভিশন প্রেজেন্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান, ভালোই চলছিলো, কিন্তু ডাউনসাইজিং এর কবলে পড়ে ১৯৯৫ সালের দিকে চাকরি হারান চাইল্ড, সংসারের হাল ধরেন বউ আর তাঁর ছেলে, আর চাইল্ড নেমে পড়েন লেখালেখিতে, জ্যাক রিচার লেখেন মাত্র চারমাসে, প্রথম বই কিলিং ফ্লোর, যখন প্রকাশনীতে জমা দিয়েছিলেন, তাঁর কিছুদিন পর দেনার দায়ে সব বিক্রি করে দেবার দশা হয়েছিলো, আর ঠিক তখনি পুটনাম নামে আমেরিকান পাব্লিশিং কোম্পানি থেকে কল আসলো তাঁর বই ছাপানর জন্য, বদলে গেলো লি চাইল্ডের জীবন।
বইটা মোট ৫২৫ পৃষ্ঠার। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এক মুহূর্তের জন্য আপনি বিরক্ত হবেন না। ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্ট কতটা বিরক্তিহীন ভাবে করা যায় সেটা লি চাইল্ড দেখিয়েছেন। কাহিনী গড়িয়েছে ধীরেধীরে কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক চলবে দ্রুত গতিতে, ভাব্বার অবকাশ দেবেন লেখক, আর যখন এক একটি জট খুলবে, তখন লেখকের বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্কের প্রতি আপনার শ্রদ্ধা জাগবেই। গল্প বলার ধরন, বর্ণনাভঙ্গি, এক কথায় অসাধারন, প্রত্যেকটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন যথার্থ ভাবে, বাহুল্যতা বিবর্জিত একটি বই। আপনি শুধু কি হবে আর কিভাবে হবে ভাবতে ভাবতেই হয়রান হবেন নিশ্চিত। তারপর কি তারপর কি আর তারপর কি এবং কিভাবে? প্রত্যেক থ্রিলার প্রেমী মাত্রই বইটা পড়া উচিৎ বলে মনে করছি 😀 হতাশ হবেন না, জ্যাক রিচারকে ভালোবেসে ফেলবেন নিশ্চিত, তাঁর ব্যক্তিত্ব আর সাহসিকতা আপনাকে মুগ্ধ করবে, তাঁর বুদ্ধিমত্তা আপনাকে অন্যরকম তৃপ্তি দেবে। ঘুরে আসুন জ্যাক রিচারের দুনিয়ায়, যে কিনা বোহেমিয়ান হতে চায়, কিন্তু জড়িয়ে পড়ে একের পর এক সমস্যায়, আর সমস্যা সমধানে যার রয়েছে মস্তিষ্ক এবং পেশি শক্তি দুটোই।
—————–
Book: Killing Floor (Jack Reacher #1)
Author: Lee Child.
Genre: Murder mystery/ Mystery thriller.
Publication: Bantam Books.
Number of Page: 525.
পাঠপ্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ Foysal Khan