একটা ‘অশ্লীল’ লেখার বিচার

0

প্রখ্যাত উর্দু কথাশিল্পী সাদাত হোসেন মান্টো (১৯১২-১৯৫৫) তার ‘গল্পলেখক ও অশ্লীলতা’-বইয়ে সাহিত্যের সাথে শ্লীলতা বা অশ্লীলতার সম্পর্কের স্বরুপ উন্মোচন করছেন অনেক বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার সাথে। পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে তখন তার যে গল্পগুলারে অশ্লীল ধরা হতো বা হয়েছিলো, সেগুলা এখন পড়লে বাঙালি পাঠকের আরামই লাগবে তুলনামূলক, ফলে, ওই আরামের জায়গা থেকে মান্টোর অশ্লীলতা সম্পর্কীত আলাপ আরো ভালোরকম প্রাসঙ্গিক। মূলত, মান্টোর কাছ থেকে কয়েকটা কোটেশন ধার করে এই লেখা শুরু করব।

সাদাত হোসেন মান্টো তার এই বইয়ের ‘কষ্টিপাথর’ নামক রচনায় বলেন, ‘সাহিত্য এমন ধরনের লাশ নয়, যাকে ডাক্তার তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে পোস্টমর্টেম করতে পারেন। সাহিত্য রোগ নয়, রোগের প্রতিষেধক।’ এই প্রবন্ধের-ই অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘প্রত্যেক মানুশ অপরকে পাথর নিক্ষেপ করতে চায়, এবং একে অন্যের কাজকর্ম যাচাই করতে উন্মুখ। এটাই মানুশের ধর্ম, একে কেউ রোধ করতে পারবে না। আমার বক্তব্য হলো, আপনি যদি আমাকে আঘাত হানতে চান অথবা পাথর মারতে চান, তাহলে একটু কায়দা কানুন শিখে সুন্দরভাবে পাথর নিক্ষেপ করুন।’ (কষ্টিপাথর, পৃঃ ২৯-৩০; গল্পলেখক ও অশ্লীলতা, সাদাত হোসেন মান্টো)। এই কোটেশনে মান্টোর প্রস্তাব দুইটা। এক. সাহিত্যের ফিজিক্যাল এনালিসিস করেন, কিন্তু সাহিত্য আসলে ফিজিক্স না, এইটারে পোস্টমর্টেম করা যায় না। দুই. যদি করেন পোস্টমর্টেম একান্তই, তাইলে পোস্টমর্টেম করার মতই করেন। যেন লাশ অন্তত বিকৃত না হয়। এই হলো মান্টোর আবেদন। মান্টো এই আবেদন করছেন, তার লেখায় যারা অশ্লীলতা খুঁজে পেতেন, তাদের কাছে, তাদের কথাবার্তার প্রেক্ষিতে। সাহিত্যে অশ্লীলতা কী জিনিশ, তা তো বড় আলাপের ব্যাপার (আবার কোন জরুরি আলাপের ব্যাপারই না-ও), এই লেখায় সেটা করব না। মূলত মীর হাবিব আল মানজুরের একটা লেখা এবং তার প্রেক্ষিতে অশ্লীলতার প্রসঙ্গ সামনে আসা-এই দুই নিয়েই কিছু লেখব বলে আশা রাখি।

দুইদিন আগে মীর হাবিব আল মানজুরের লেখা একটা কবিতারে অশ্লীলতার দায়ে দণ্ডিত করা হয়েছে। মীর হাবিব আল মানজুরের কবিতাটা আগে পড়ি। কবিতা যেহেতু, কবিতার মতই পড়ি-

“আমরা প্রত্যেকে আমাদের চিন্তাগুলো নিয়ে বেশ্যা হওয়ার দিকে এগিয়ে যাই।
আমরা প্রত্যেকে আমাদের সমকামী ভাবনাগুলো নিয়ে লেসবিয়ান হতে এগিয়ে যাই।
আমরা প্রত্যেকে কুকুরসঙ্গমে নিমজ্জমান আমাদের চেতনাগুলোকে নিয়ে হেঁটে বেড়াই।
আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ঘুর-চক্রমান একই বিভাবন নিয়ে সান্তোষের লিঙ্গ উত্থিত করি।

আমাদের প্রতিটা কার্য-ব্যাখ্যার অতি সীমাবন্ধ্যত্ব আমাদের আরো একবার ফেনিয়ে ওঠা হস্তমৈথুনে অঙ্গ সঞ্চালন করে।আমরা ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে ব্যবহৃত হয়ে তারপর ব্যবহৃত ব্যবহৃত বারবার বারবার ব্যবহৃত হয়ে অতিরিক্ত অশুভ গে হয়ে অত:পর শান দেয়া যোনি হয়ে উঠি।অথচ শানানো খঞ্জর, দীপ্তি-তৃপ্তি আর ক্ষিপ্রতায় অতীব কার্যকর।”

এই হলো কবিতা। কবিতাটার ভাষা তীব্র, বক্তব্য তীক্ষ্ণ, একজন তরুণ কবির জীবনজিজ্ঞাসা ও যৌবনযাপনের সমূহ অস্বস্তি ও তৎসঞ্জাত বিদ্রোহ এই কবিতায় ফুটে উঠছে। এই কবিতাটা কি অশ্লীল? অশ্লীলতা দুই ধরনের মনে হয়, পাঠকের মাথায়। শব্দের অশ্লীলতা আর অর্থের অশ্লীলতা। টেক্সটের অশ্লীলতা আর কনটেক্সটের অশ্লীলতা। বলিউডের মুভিতে রাভিনা টনডনের ভেজা শাড়িপরা দেহে যৌনতা মারাত্মকভাবেই আছে, কিন্তু সে তো শাড়ি পরা! এই হইলো কনটেক্সটের অশ্লীলতা। আবার, অনেক মুভিতে, সরাসরি নগ্ন দেহ প্রদর্শন করছে। হয়তো দৃশ্যটা হলো এমন যে, মাত্র সে ধর্ষিতা হয়েছে; স্বাভাবিক বিচার বোধ থাকলে ওখানে যৌনতা জেগে ওঠার অর্থ নেই; তবু কারো কারো বা অনেকেরই উঠবে। কারণ, টেক্সট ইটসেলফেরও একটা যৌন আবেদন থেকেই যায়।

এখন, এই লেখায় অশ্লীলতাটা কই? টেক্সটে না কনটেক্সটে? যারা লেখার কনটেক্স বুঝেছেন, তারা কেউ কেউ বলবেন টেক্সটে। যারা বুঝেন নাই, তারা বলবেন কন্টেক্সটেও। না, এই লেখার কন্টেট আসলে অশ্লীল না। যদিও কন্টেইনারের দেহখানারে অশ্লীল বলতে পারেন (আপাতত, এই পর্যন্ত আলাপে)। কন্টেন্ট কী এই লেখার? লেখক তার এবং তার সমসাময়িক লোকজন, সম্ভবত লেখক কবিদেরই কিংবা তার বলয়ের সকল মানুশেরই ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, বোধ-বিশ্বাস এসব নিয়া অসন্তুষ্ট। এতটাই যে, প্রথমেই তিনি বলছেন, ‘আমরা প্রত্যেকেই আমাদের চিন্তাগুলো নিয়ে বেশ্যা হওয়ার দিকে এগিয়ে যাই।’ এইখানে পাঠকভেদে অশ্লীলতা-নির্ধারণের স্তর ভেদ হবে। তৃতীয় শ্রেণীর পাঠক, যিনি এই কবিতার টেক্সট ও কনটেক্সট-কিছুই বুঝবেন না, তিনি ‘বেশ্যা’ শব্দটা দেইখাই চোট খাবেন। তা তিনি জীবনে বেশ্যাগমন করেন বা না করেন। তার কাছে ওই শব্দটাই অশ্লীল, ওই শব্দ উচ্চারণের পরে ডাইন-বাম দেখার তার টাইম নাই, ওইটাই মাথায় ঘোরে। দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠক, তিনি টেক্সট দেখবেন। ‘আমরা বেশ্যা হওয়ার দিকে এগিয়ে যাই’!! কী সাংঘাতিক কথা। আমাদের কি বেশ্যা হওয়ার প্ররোচনা দেয়া হলো? বা বেশ্যা ব্যাপারটারে কি খুব ইতিবাচকভাবে দেখা হলো? এইসব তাদের চিন্তায় ঘুরবে, যেহেতু, ‘বেশ্যা’ শব্দের এক দুর্নিবার কল্পজগত পার হয়া ডান-বাম দেখতে পারলেও, এই পাঠকেরা কনটেক্সট ধরতে পারেন নাই। ফলে, তাদের কাছেও ব্যাপারটা অশ্লীল। এইবার প্রথম শ্রেণীর পাঠকের আলাপে আসি। যিনি এই কবিতার কনটেক্সট বুঝবেন, তিনি খুব সহজেই শব্দের এই আপাত নড়বড়ে সাঁকো পার হয়ে ওপারের শাশ্বত সুন্দর ভাবের জগতে পৌঁছতে পারবেন। আমাদের চিন্তাগুলি এতটাই দূষিত, এতটাই পরোন্মুখ, এতটাই আত্মমর্যাদাহীন, এতটাই নোংরা, এতটাই অপরিণত, এতটাই অপরিণামদর্শী যে, লেখক ভাবছেন, যদি আমাদের চিন্তাগুলি মানবাকৃতি ও প্রকৃতি পেতো, তবে তারা কোন বেশ্যার আকৃতিই পেতো (বেশ্যারা দেমসেলভস এত খারাপ কিনা সেটা আলাদা ব্যাপার)। তো, আসলে তো ব্যাপারটা ধ্রুব সত্য। আমাদের চিন্তা তো এইরকম দূষিত ও নোংরাই। এই লাইনের কনটেক্সটে পৌঁছার সাথেসাথে এই প্রথম শ্রেণীর পাঠকের মনে বেশ্যার ছবি ভাসার বদলে ভাসবে তার নিজের চিন্তার সমূহ কলুষ, তার মন খারাপ হবে নিজের কথা ভেবে। সে যৌন আবহে ভাসতে পারবে না। ফলে, অশ্লীলতাও পাবে না।

পরের লাইনগুলারে এইবার এইভাবে ব্যাখ্যা করেন। ‘আমরা প্রত্যেকে আমাদের সমকামী ভাবনাগুলো নিয়ে লেসবিয়ান হওয়ার দিকে এগিয়ে যাই’-এই বাক্যটায় লেখক বক্তব্যকে তীব্রতা দিতে গিয়ে বক্তব্যকে হালকা বানিয়ে ফেলছেন। কারণ, আমরা সকলেই আসলে ‘লেসবিয়ান’ হতে পারব না। কিন্তু সেইটা আমার পয়েন্ট না। ‘সমকাম’ আর ‘লেসবিয়ান’ শব্দদুইটায় অর্থাৎ টেক্সটে যারা মজে গেলো, তারা গেলো। শেষ। তারা ওইখান থেকে বের হইতে পারবে না। কিন্তু আসলে এইখানে কহতব্য ব্যাপার কী? আমাদের চিন্তারে ‘বেশ্যা’ বলে কবি ক্ষান্ত হতে পারছেন না। বেশ্যাবৃত্তি এখন, যৌনতার মোটামুটি একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের চিন্তা এতটাই বিকৃত যে, কবি এখন এইটারে আরো বিকৃত যৌনতা বা সমকামের লগে তুলনা দিচ্ছেন। অর্থাৎ, আমাদের চিন্তাগুলা সমকামের মতই বিকৃত; আবার, সমকামীরা যেমন স্বজাতিরই ** মারে, আমাদের চিন্তাগুলাও এইরকম, একে অপরের ** মারায় ব্যস্ত। ফলে, আমাদের চিন্তাগুলা যেন সমকামিতায় লিপ্ত! ভয়াবহ ব্যাপার। সমকামিতারে এইখানে কবি আমাদের চিন্তার কদর্যতার উপমা বানাচ্ছেন, ফলে, সমকামিতাকেও তিনি যে বিকৃতই ভাবছেন ও বলছেন তা তো অনুমেয়! এই লাইনটাকে গদ্যরুপ দেই একটু। দিলে এই দাঁড়ায়-‘আমাদের চিন্তাগুলি এতটাই কদর্য, যেন সমকামিতায় লিপ্ত, আমরা সকলেই যেন একেকজন সমকামী।’ এখন আর অতটা অশ্লীল লাগে না, নাকি! হাহাহা।

‘আমাদের প্রতিটা কার্য-ব্যাখ্যার অতি সীমাবন্ধ্যত্ব আমাদের আরো একবার ফেনিয়ে ওঠা হস্তমৈথুনে অঙ্গ সঞ্চালন করে’-এই লাইনটার কী মানে? এইটা মেবি অলৌকিক ব্যাপার, কবিরা সাধারণত দ্রষ্টা হন, এই লাইনটা কবির দ্রষ্টা হওয়ার প্রমানমূলক একটা লাইন। এই কবি, মীর হাবিব আল-মানজুর, যেন জানতেনই যে, এই কবিতার সমালোচনায় রত হবে অনেকে। এই লাইনটা তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই লেখা যেন। আমরা যেকোন জিনিশরে ব্যাখ্যা করি খুবই ক্ষুদ্র জ্ঞান ও গণ্ডি নিয়ে। যেকোন জিনিশরে ব্যাখ্যা করতে আমাদের হাতে যে উপাদান, তা বড় সীমিত। সেই উপাদান দিয়ে তো আসলে ওই জিনিশ ব্যাখ্যা চলে না। যেমন, হুদা ফেকাহ শাস্ত্র দিয়ে কি কবিতার ব্যাখ্যা চলে? কস্মিনকালেও না। কিন্তু, আমাদের আছে কেবল ফেকাহর জ্ঞান। আবার কবিতার ব্যাখ্যাও করতে চাই। ফলে, ওই সীমিত উপকরণ দিয়াই আমরা কবিতা ব্যাখ্যা শুরু করি। কবি বলছেন, এই সীমিত উপকরণ দিয়ে যেকোন কিছুকে ব্যাখ্যা, প্রত্যেকটা কাজরে খুবই সীমিত উপকরণ ও চিন্তা দিয়ে বোঝার চেষ্টা-এইটা আসলে এক ধরণের হস্তমৈথুন। হস্তমৈথুন মানুশ কেন করে, কখন করে? যখন আর কোন উপায়ই নাই, তার কাছে না আছে নারী, না অন্য কোন উপায়, তখন লাস্ট উপায় হিশাবে মাস্টারবেশন (অন্য কারণেও হস্তমৈথুন হতে পারে, কবি যেটা বুঝিয়েছেন সেইটা বললাম আরকি)। তো, সংকীর্ণ আবদ্ধ ঘরে নিরুপায় হস্তমৈথুন যেমন যৌনতার স্বাদ না দিয়ে একটা বিষাদ তৈরি করে, সকল কাজরে একটা সীমাবদ্ধ মাপকাঠি দিয়ে, একটা সীমিত জ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টাও ঠিক তদ্রুপ। লেখকের এই কথায় আপনার মন খারাপ হতে পারে এই ভেবে যে, আমার জ্ঞানরে এইভাবে অপমান করলো; বাট অশ্লীলতা আপনি পেতে পারেন না। আসলে, কবি যে এইখানে সমালোচকের স্বল্প জ্ঞানরে অপমান যে করছে, তা তো আপনি বোঝেনই নাই। আপনি বুঝেছেন, যেটা সচরাচর বুঝা যায়-হস্তমৈথুন।

শেষ দুইটা প্যারায় কবি কী বলছেন, স্পষ্ট না। প্যারা দুইটা এই-

‘আমরা ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে ব্যবহৃত হয়ে তারপর ব্যবহৃত ব্যবহৃত বারবার বারবার ব্যবহৃত হয়ে অতিরিক্ত অশুভ গে হয়ে অত:পর শান দেয়া যোনি হয়ে উঠি।                                                     অথচ শানানো খঞ্জর, দীপ্তি-তৃপ্তি আর ক্ষিপ্রতায় অতীব কার্যকর।’

যতটুক আমি বুঝেছি, তা বলি। এইখানে কবি বলছেন, আমরা অপরের দ্বারা ব্যবহৃত হতে হতে, অপরের গোলামি করতে করতে, অপরের কাছে পিছন পেতা দিতে দিতে এক আত্মমর্যাদাহীন অশুভ গে হয়ে যাই যেন, এতেই শেষ না, একসময় আমরা ভুলেই যাই যে, আমাদের একটা পুরুষাঙ্গ আছে বা ছিল; আমরা আসলে পুরুষ। ওই পুটুমারা খাওয়া আমাদের এমন নিয়তি হয়ে যায় যে, আমরা ভাবি, আমরা বোধহয় যোনী-ই ধারণ করেই আসছি আজীবন, আমাদের বোধহয় এই নিয়তি। এরপর শেষ প্যারায় তিনি বলছেন, ‘অথচ শানানো খঞ্জর, দীপ্তি-তৃপ্তি আর ক্ষিপ্রতায় অতীব কার্যকর।’ শানানো খঞ্জর বলতে বোধহয় তিনি পুরুষাঙ্গ-কে বুঝিয়েছেন। সেক্ষেত্রে অর্থ দাঁড়ায় এই-আমরা তো অনুকরণ আর গোলামি করতে করতে নিজেদের পুরুষাঙ্গ লুপ্ত করে নিজেদের মনে করতে থাকি যে, আমরা হয়ত যোনীধারী, ফলে, এই ‘ব্যবহৃত হওয়া’-ই বোধহয় আমাদের নিয়তি, এবং আরো ভাবি, এটা বোধহয় তৃপ্তিও বটে। কিন্তু লেখক বলছেন, না, তৃপ্তি আর উৎকর্ষে সেরা ও শ্রেষ্ঠ সে-ই, যার আছে ‘শানানো খঞ্জর’ তথা পুরুষাঙ্গ, সে না, যার আছে যোনী। অর্থাৎ, যে নিজে কাজ করে, সেই শ্রেষ্ঠ, যে অনুকরণ করে ও ব্যবহৃত হয়-সে না। এইখানে, যোনী ও পুরুষাঙ্গ-র উপমায় যে ভাব কবি তুইলা ধরছেন, সেই ভাব ও অর্থ ঠিক থাকলেও, সেই ভাবের উপমায় যোনী আর পুরুষাঙ্গ-কে ব্যবহার করা ঠিক হয়নাই। অশ্লীলতার কারণে না, এই ব্যবহার নারীর প্রতি এক ধরণের অবমাননা বা এক ধরণের অবচেতন পুরুষালী শ্রেষ্ঠত্ব। ফ্রয়েডিয় চিন্তার প্রকাশ ঘটছে এইখানে। ফ্রয়েড ভাবতেন, কেবলমাত্র লিঙ্গ আছে বলেই পুরুষ শ্রেষ্ঠ। নারী ছোটবেলায় তার ভগাঙ্কুর দেইখা ভাবে যে এইটাও পুরুষাঙ্গ ছিল, বাট, খইসা গেছে কোন কারণে, আর এই পুরুষাঙ্গ নাই বইলাই নারী হীনমন্যতায় ভোগে এবং পুরুষরে ঈর্ষা করে। ফ্রয়েডের এই চিন্তাধারা তো উত্তরকালে ভুল প্রমানিত ও সমালোচিত হইছে। কবির এই লাস্ট লাইন দুইটাতে অনুকরণকারীর দুর্ভাগ্যের উপমায় ‘যোনী হয়ে ওঠা’ এবং যে নিজে কাজ করে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও ‘দীপ্তি-তৃপ্তি’-তে অগ্রগামীতার তুলনায় ‘শানানো খঞ্জর’ বা পুরুষাঙ্গরে আনা ফ্রয়েডের ওই চিন্তার প্রতিফলন, যা আমি ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনার যোগ্য মনে করি।

লাইন বাই লাইন ধরে ব্যাখ্যার সুযোগ নাই। তাও মোটামুটি মুখটা ধরিয়ে দিলাম। এইবার এই কনটেক্সট মাথায় রেখে লেখাটা পড়েন। অশ্লীল লাগতেছে কী? কবিতার কথাগুলিরে গদ্য বানায়ে পড়েন। অশ্লীল লাগে? একটু কম কম! যাহোক, কথা থেকেই যায়। কথা থাকে এই যে, শব্দ তো ছবি। শব্দ শোনা বা দেখার সাথেসাথেই প্রতিটা শব্দ মাথায় আলাদা আলাদা ছবি বানায়। কয়েকটি শব্দ মিলা যে বাক্য হয়, সেই বাক্য যে ছবি বানায়, ওই ছবি মাথায় হুট করে আসে না, ভাবা লাগে। আগে আসে শব্দের ছবি। যেমন, আমি ভাত খাই। এইখানে, বাক্যের ছবিটা বুঝতে খানিক ভাবা লাগে। আগে শব্দের ছবি মাথায় আসে। ‘আমি’ একটা ছবি শ্রোতার মাথায় দেয়, ‘ভাত’ একটা ছবি দেয়, ‘খাই’ একটা ছবি দেয়। তিন ছবি জোড়া দিলে বাক্যের ছবি আসে। একটা সরল বাক্যের বেলায়ই এই অবস্থা। তো কবিতা, যেইখানে প্রতিটা শব্দই রুপকের আড়ালে লুকায়ে থাকে, যেইখানে শব্দের প্রচলিত অর্থ ভাঙা হয় অহরহ, যেইখানে শব্দের গতানুগতিক ছবি আর কবির উদ্দিষ্ট অর্থের পার্থক্য যোজন যোজন-সেইখানে বাক্যের ছবি তো সাধারণ পাঠকের মনে আসবেই না, শব্দের উদ্দিষ্ট ছবিও আসবে না, আসবে শব্দের ওই ছবি যা গতানুগতিক। ফলে, ‘সমকাম’ লেখলেই মাথায় আসবে স্বাভাবিক সমকামের ছবিই , এইখানে সমকাম যে কদর্যতার প্রতীক, চিন্তার বিকৃতির প্রতীক সেই কবির উদ্দিষ্ট ছবি ও অর্থ মাথায় আসবে না, আর গোটা বাক্যের ছবি ও কনটেক্সট আসা তো আরো পরের ব্যাপার। এ ব্যাপারে করণীয় কী? করণীয় আসলে কিছু নাই। নাই, আর এজন্যেই জীবনানন্দ বা মান্নান সৈয়দ বলছেন, কবিতা সবার জন্যে না, যেহেতু এর শব্দ ও বাক্যের কনটেক্সট, শব্দের কোন ছবিটা পাঠকের মাথায় দেয়া কবির উদ্দেশ্য, সেগুলা সকলে বুঝবে না। ফলে, কবি যদি লেখে ‘আমাদের সমকামী চিন্তাগুলো’, সাধারণ পাঠক সাধারণ ‘সমকাম’-র ছবিই দেখবে, চিন্তাগুলো সমকাম করতেছে মাথার ভেতরে, চিন্তারা আসলে সমকাম কীভাবে করে, এর কী অর্থ- এই ছবি সে ভাবতেও পারবে না, কারণ তার ওই ইমাজিনেশন এবিলিটিই নাই। ফলে, কবিতা সকলের না, এই বাক্যই হয়ত এর সমাধান। আর লেখকের কাছে এ ব্যাপারে কথা হলো, শব্দ যখন তার ছবি বা অন্তর্গত ভাবকে টপকিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে তখন টেক্সটই অশ্লীল হয়ে ওঠে। যেমন, কলা একটা নীরিহ ফল। অথচ, এই টেক্সটটা এখন অশ্লীল ইঙ্গিতে ব্যবহার হয়। ফলে, শব্দ আর ভাবের ব্যালান্স করতে হবে। ভাব শব্দের উপ্রে প্রবল হইলে শব্দের মাহাত্ম্য থাকে না (অথচ শব্দই ব্রহ্ম), আবার শব্দ ভাবের উপরে রাজত্ব করলে কনটেক্সটে ঢোকা যায় না, ফলে লোকে শব্দের উপর ডিপেন্ড করেই শ্লীল আর অশ্লীলের সিদ্ধান্ত নেয়। তাই, বক্তব্যরে তীব্রতা দেওয়ার জন্য ভাবরে মেরে ফেলে তীব্র তীব্র শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন নাই, এই আমার ব্যক্তিগত অভিমত।

যাহোক, আবার মান্টোর কথায়ই ফিরি, সাহিত্য পোস্টমর্টেম আইটেম না। একে কাটাকুটি করলে এর আসল স্বাদ থাকে না। মানুশ বা লাশরে কাটলে কি রুহু বা প্রাণ পাবেন? না। কাটলে পাবেন দুর্গন্ধ, গু, নাড়িভুঁড়ি। অথচ, ওই যে ঐশ্বর্যময় প্রাণ, যার বলে সে হাসত, ভালবাসত তা পাবেন না। ফলে সাহিত্যের বিশেষত কবিতার কাটাকাটি চলে না। আর যদি করতেই হয়, তাইলে মান্টোর ভাষায়- ‘একটু কায়দা কানুন শিখে সুন্দরভাবে পাথর নিক্ষেপ করুন।’ নইলে অবস্থাটা আসলে মানজুরের কবিতার মতই দাঁড়াবে-‘আমাদের প্রতিটা কার্য-ব্যাখ্যার অতি সীমাবন্ধ্যত্ব আমাদের আরো একবার ফেনিয়ে ওঠা হস্তমৈথুনে অঙ্গ সঞ্চালন করে।’ সীমাবদ্ধ উপকরণ দিয়ে কার্য-ব্যাখ্যা থেকে এবং হস্তমৈথুন থেকে আল্লাহ আমাদের বোধকে হেফাজত করুন। আমিন।

লেখকঃ তুহিন খান

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে