রক্তলোভী ভাইপার : একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া

0
রক্তলোভী ভাইপার

বইঃ রক্তলোভী ভাইপার
লেখকঃ কুয়াশা
জনরাঃ- থ্রিলার
প্রকাশনীঃ প্রাচী প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : সুভাষ দত্ত (চিত্র পরিচালক)
প্রথম প্রকাশঃ মে, ১৯৫৪
৩য় সংস্করণঃ এপ্রিল, ১৯৯৪
পৃষ্ঠাঃ- ১৩৪ রক্তলোভী ভাইপার

১৯৫৪ সালে এত দারুন রহস্য, ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখেছেন ভাবতে ভালো লাগে।সে সময়ে এই পূর্ব বাংলায় রহস্য উপন্যাস লেখা হয়নি।যদিও পশ্চিমে তখন কিরীটী রায় সহ অনেকে লিখছেন এমন জনরায়। পাঠকের অনেক চাহিদার পরেও এই বইটি ছাপাতে দেরি হয় শুধুমাত্র কাগজের অভাবের কারনে। এটা ভাইপার সিরিজের ২য় বই।প্রথমটা হলো ‘ভাইপারের মরণ ছোবল’।

নামকরণঃ বইটার নামের মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে।খুনী, সাইকো ধরনের। বইটা পড়ার পর মনে হয়েছে নামটা একেবারে যথার্থ। আর বইটার ৩য় সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছেন বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত।তখনকার সময় হিসাব করলে প্রচ্ছদ দুর্দান্ত ছিল।দারুন একেছেন তিনি।

কাহিনী সংক্ষেপঃ শরীরের উন্নতি সাধনের জন্যে বায়ু পরিবর্তন করতে শিলাভাঙ্গায় যায় সেলিম আর বশির।সেখানে পরিচয় হয় অরুণ কুমার নামে একজনের সাথে। তার কাছ থেকে তারা শুনতে পায় এক অদ্ভুত কাহিনী। এক কালো ঘোড়ার কালো সওয়ারের কাহিনী।সে প্রত্যেক পূর্ণিমায় বের হয় শুধু।গ্রামের মানুষ খুব ভয় পায় এই ঘোড়া সওয়ারিকে।এর কারন কি?

হঠাত করে গ্রামের এক বিয়েতে খুন হয় বর।মন্ত্র পাঠ করার সময় ইলেকট্রিক লাইট অফ হয়ে যায়।লাইট যখন আসে তখন দেখা যায় বর মারা গেছে। কে যেন তার গলায় রেশমি ফাশ।পরে তার পকেট থেকে একটা কাগজ পাওয়া যায়।তাতে আকা ছিল পাশাপাশি ৭ টি চতুর্ভুজ। তিনটি কালো রং আকা একটি লাল আর তিনটি খালি।শুধু আকার দেয়া।এই কাগজ দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে তা বুঝতে পারলোনা তারা।

পত্রিকা মারফত খবর শুনে থানায় যায় সেলিম।ডিটেকটিভ হিসাবে ভালো নাম কামিয়েছেন তিনি।পুলিশ তার পরিচয় জানতে পেরে তাকে কেসটা নিতে বললো।অনুরোধ পেয়ে কেসটা নেয় সেলিম।কেসটা তাকে ভাবিয়ে তুলে।সেলিম বুঝতে পারে খুনি যথেষ্ট পরিমান চালাক।

কি করবে যখন ভেবে পাচ্ছিল না সেলিম তখন পুলিশ অফিসার এসে বলে খুনি ধরা পড়েছে।খুনি আর কেউনা।তাদের সাথে পরিচিত হওয়া যে যুবক অরুণ। কনে তার প্রেমিকা ছিল। পুলিশ তাই সন্দেহ করছে তাকে।এই ব্যাপারে নাকি শক্ত প্রমান আছে।কিন্তু সেলিমের তা মনে হচ্ছেনা।তাই সে তার মতো তদন্ত চালিয়ে যায়।

ঘটনা পরিক্রমায় সেলিম জানতে পারে গ্রামের নবাব বাড়ির মরণ কুঠিরের কথা। ওখানে নাকি একটা সুড়ঙ্গ আছে। যে লোক একবার সুড়ঙ্গতে প্রবেশ করে সে আর ফিরে আসেনা। সেলিম অন্য কিছুর গন্ধ পায়। তাই সে আর বশির মিলে যায় সেখানে।ভিতরে ঢুকলে কিছু কংকাল দেখতে পায় তারা। আরো ভিতরে গেলে একটা লাশ দেখতে পায়। তখন টর্চ বন্ধ হয়ে যায়। টর্চে ব্যাটারি লাগানোর আগে কিছু ঘটনা ঘটে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগে বশির খেয়াল করে সেলিম পাশে নেই। উধাও সে। ঠিক তখনি এক প্রেতাত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে সে। ভয়ে পালাতে চাইলে উলটো বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে। পরের দিন নিজেকে নদীর ধারে আবিষ্কার করে। পকেটে অজানা এক ‘ব্লাক রাইডার’ এর একটা চিঠির অস্তিত্ব পায়।

কে এই ব্লাক রাইডার?তার উদ্দেশ্য কি? সেলিম কি উদ্ধার হবে?অরুণ কি আসলে খুনি?নাকি খুন অন্য কেউ করেছে।ভাইপারটা কে?এসবের সাথে তার সম্পর্ক কি?

হঠাত করে বলে কয়ে খুন করে যাচ্ছে এক লোক। পুলিশ কিচ্ছু করতে পারছেনা। এসবের সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে? শেষ পর্যন্ত কি হলো? ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ বইটি উৎসর্গ করা হয় নীহাররঞ্জন গুপ্ত কে। তিনি কিরীটীর লেখক। এই বইতেও কিরীটীর কথা দুবার আসে বশিরের জবানীতে।

বইয়ের শুরুটা অনেকটা ব্যোমকেশের মতো। শেষটাও মিলে অনেকটা।অনেক ব্যোমকেশের কাহিনীতে সে হাওয়া বদলে যায়। সেখানে তার সুনাম পাওয়া যায়। তখন সেখানে একটা ক্রাইম হলে ব্যোমকেশের উপস্থিতির কারনে তাকে কেস নিতে অনুরোধ করা হয়। কেস সলভ হলে সবাইকে একসাথে নিয়ে বসে কেসের খুঁটিনাটি বলে ব্যোমকেশ। এসব কিছু এই উপন্যাসে আছে। তাই আমার পড়ার সময়ে প্রথম দিকে ব্যোমকেশের কথা মনে হচ্ছিল।যদিও মাখখানে ব্যোমকেশের সাথে মিল পাবেননা।এখানেই ব্যোমকেশের সাথে সেলিমের পার্থক্য।

পড়ার সময়ে ভাষাগত সমস্যা হয়নি।এত আগের বই পড়ার সময়ে একটা ভাষাগত সমস্যা সামনে চলে আসে।তবে বিভিন্ন পত্রিকার ঘটনা বর্ণনায় এটা পাবেন। ওখানে আসিয়াছে চলিয়াছে এমনভাবে লেখা হয়েছে।আর বইতে অনেক ইংরেজি বাক্য ও শব্দ আছে। সেখানে ইংরেজি শব্দগুলো বাংলায় না লিখে ইংরেজিতেই রাখা আছে। এই জিনিসটা ভালো লাগছে।এছাড়া লেখক ডাক্তার হওয়ায় কিছু জায়গায় বিভিন্ন মেডিকেল শব্দ সামনে এসেছে।কিন্তু তা বুঝতে অসুবিধা হয়না। কাহিনী ভালো লেগেছে।প্লট ভালো ছিল।

“সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম গগনে। পূর্ব আকাশ প্রান্তে পূর্নিমার চাঁদ উঠেছিল গতকাল, ঠিক যেন নতুন বধুটির মতো সেজেগুজে। আজও তার আবির্ভাব হবে কিছু পরেই।সন্ধ্যার আচলটি যখন ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। বধুরুপিনী চাঁদকে দেখে যে সলজ্জ হাসি হেসেছিল পশ্চিম আকাশ আজও তার রেশ যায়নি।লাজারুণ রাগে আরক্ত হয়েছে পশ্চিম আকাশের কপোল”
এমন দারুন কিছু বর্ণনা পাবেন বইতে।
এছাড়া রবীন্দ্র সংগীত পাবেন বেশ কয়টি বশিরের জবানীতে।যা বইয়ের প্রতি ভালোলাগা বাড়ায়।

পজিটিভঃ বইটা আপনাকে ভালোই ভুগাবে খুনি কে তা চিন্তা করে বের করতে।থ্রিলটা ছিল শেষ পর্যন্ত। লেখকের বর্ণনা ভালো ছিল। বইয়ের প্রথম বর্ণনাটা খুব সুন্দর ছিল।খুনের ধরনগুলো বেশ পছন্দ হয়েছে আমার। এছাড়া প্রতি অধ্যায়কে এক একটা নাম দেন তিনি।নামগুলো আগ্রহ জাগাচ্ছিল সামনে পড়তে। এটা ভালো লেগেছে।

নেগেটিভঃ শেষের দিকে কাহিনী খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। দৃশ্যপটগুলোর দ্রুত পরিবর্তন অনেক সময় পড়তে বাধা দেয় একটু।আর বইতে প্রিন্টিং মিস্টেক ছিল অনেক। এক পেইজে এক জায়গায় কুমার লিখছে দুলাইন পরে দত্ত। কিন্তু একেবারের জন্যে কোন জায়গায় বলে নাই যে তার নাম অরুন কুমার দত্ত। এক জায়গায় বশির চিন্তা করে সেলিম অমুক জায়গায় বন্ধি আছে তাকে কি করে উদ্ধার করা যায়?কিন্তু আসলে বশিরের জানার কোন উপায় ছিলনা আর সে জানেওনা।এমন ভুল কেন করেছে জানিনা।

তবে এই বইটি দারুন একটি বই এটা বলাই যায়। এই লেখকের বই এখন রেয়ার। পাওয়া যায়না। আমি পিডিএফ পড়েছি। এসব বই আবার নতুন করে প্রিন্ট করা উচিত যাতে বই পড়ুয়ারা এই সব পুরাতন দারুন কিছু বই পড়তে পারে।

নাম নিয়ে বিভ্রান্তিঃ কুয়াশা লেখকের ছদ্মনাম। মূল নাম হলো ডাঃ আবু হায়দার সাজেদুর রহমান।১৯৯৪ সালের বইমেলায় নতুন করে বইটি বের হলে পাঠক-পাঠিকারা মনে করে এটা সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা সিরিজের বই। পরে কাজি আনোয়ার হোসেন সাপ্তাহিক ‘রোববার’ নামক একটা পত্রিকায় একটা সাক্ষাতকারে তিনি পাঠক-পাঠিকাদের জিজ্ঞাসার জবাব দেন।তিনি বলেন-
“কুয়াশা লেখার সময় ‘মাকড়সার জাল’,’কুয়াশার অন্তরালে’ এরকম কটি নাম মনে মনে ঠিক করেছিলাম।কিন্তু আট বছর পর যখন ছাপাতে যাচ্ছি তখন ব্যবসার বুদ্ধি চাপল মাথায়। সে যুগের দারুন জনপ্রিয় লেখক ‘কুয়াশা’- ভাইপারের মরন ছোবল ইত্যাদি বেশ কিছু চমতকার বই লিখে আমাদের মাতিয়ে দিয়েছিলেন। ভাবলাম ঐ নামে যদি সিরিজ লিখি তাহলে বুঝি খুব চলবে।…”

পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ আল কাফী হাসিব‎

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে